*আন্তর্জাতিক জোটনিরপেক্ষ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা :

সূচনা: 

স্বাধীনতা লাভের আগে পর্যন্ত ভারতের নিজস্ব কোনো বিদেশনীতি বা পররাষ্ট্রনীতি ছিল না। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর আমলেই প্রথম স্বতন্ত্র বিদেশনীতি গৃহীত হয়। অহিংসা ও শান্তিকে ভিত্তি করে ভারত তার পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে অগ্রসর হয়। চিরাচরিত ঐতিহ্যকে সে কখনও উপেক্ষা করেনি। তাই পামার ও পার্কিন্‌স বলেছেন— এদেশে বহু শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা সভ্যতাসমূহের মধ্যে, বিশেষত হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম, জীবনদর্শন ও চিন্তাশৈলীর মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মূল নিহিত আছে।


জোটনিরপেক্ষ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা

ভারতের জোটনিরপেক্ষ নীতি আন্তর্জাতিক রাজনৈতক ক্ষেত্র থেকে অপসরণ নয়, বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণের একটি উপায়; নেহরু বলেছিলেন—ঠান্ডা লড়াই ও তার সংশ্লিষ্ট সামরিক চুক্তিগুলির ক্ষেত্রে আমরা নির্জোট। জোটনিরপেক্ষ রাজনীতির অর্থ হল যুদ্ধপরবর্তী বিশ্বের দুই শক্তি শিবির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , সোভিয়েত ইউনিয়ন — এদের কোনো পক্ষের সাথেই হাত না মিলিয়ে স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রাখা ।

 > জোটনিরপেক্ষতার সফলতা :

 1 ] দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়ায়

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ সংক্রান্ত জটিল সমস্যা সমাধানে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে ভারত এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে । প্রথমে কোনো পক্ষই ভারতকে আমল না দিলেও পরে তার যুদ্ধবিরতির উদ্যোগকে উভয় শক্তিই স্বাগত জানায় । যুদ্ধবিরতির পর বন্দি বিনিময় নিয়ে সমস্যা দেখা দিলে ভারতের মধ্যস্থতায় জেনারেল থিমাইয়ার নেতৃত্বে এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হয় ।

 ইন্দোচিনে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম ও পরে ভিয়েতনাম সমস্যা সমাধানেও ভারতের ভূমিকা ছিল খুবই উল্লেখযোগ্য । ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলের জনসাধারণের মুক্তিসংগ্রামকে ভারত খোলা মনে সমর্থন করে । এ ব্যাপারে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে জেনেভা সম্মেলনেও ভারতের ভূমিকা ছিল গৌরবজনক । সম্মেলনের যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করার জন্য তিনটি কমিশন নিযুক্ত হয় । সেগুলির সভাপতি নিযুক্ত হন জে . এম . দেশাই , জে এন . খোসলা এবং জে পার্থসারথী ।

 ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে চিনে সাম্যবাদী প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হলে মার্কিনজোট প্রজাতন্ত্রী চিনকে জাতিপুঞ্জে স্বীকৃতি দেয়নি বিবাদ থাকা সত্ত্বেও চিনকে জাতিপুঞ্জের সদস্য করার পক্ষে সমর্থন জানিয়ে ভারত জোরালো বক্তব্য রাখে অবশেষে কমিউনিস্ট চিনকে জাতিপুঞ্জ বা রাষ্ট্রসংঘের সদস্যরূপে গ্রহণ করা হয় । 

[2] পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকায়:


[i] মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক জোট স্থাপনে: ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক জোট স্থাপনের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটো ও বাগদাদ চুক্তি ভারত অগ্রাহ্য করে।


[ii] পশ্চিম এশিয়ার মুক্তি আন্দোলন: পশ্চিম এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রাম ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে ভারত অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়।


[ii] সুয়েজ সংকটের সমাধানে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে সুয়েজ সংকট এবং মিশরের ওপর ইঙ্গ-ফরাসি ও ইজরায়েলি আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারত তীব্র প্রতিবাদ জানায়। নেহরু মিশরকে সাহায্য করতে ভারতীয় সেনা পাঠানোর হুমকি দেন। জাতিপুঞ্জের হস্তক্ষেপে আক্রমণকারীরা মিশর ত্যাগ করে । এইভাবে মিশর সমস্যা সমাধানে ভারত সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে । 

[ iv ] কঙ্গোতে শান্তিস্থাপন কঙ্গোকে ঐক্যবদ্ধ রেখে সেখানে শান্তিস্থাপনের জন্য রাষ্ট্রসংঘ বাহিনীকে সাহায্য করতে ভারত সেনাদল পাঠায় ।

 [ v ] আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রামে আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রামে ভারত দ্বিধাহীন সমর্থন জানায় । 

[ 3 ] তৃতীয় বিশ্বের নেতৃত্বদান : ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ভারত ও চিনের মধ্যে পঞ্চশীল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । শান্তিস্থাপনে বিশ্ব এক নতুন পথনির্দেশ পায় । পরের বছরই ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং শহরে এশিয়া আফ্রিকার ২৯ টি রাষ্ট্রের এক সম্মেলনে ভারতের নেতৃত্বে বিশ্বে নির্জোট আন্দোলনের সূত্রপাত হয় । পরে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে যুগোশ্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । সেখানেও ভারত ছিল মধ্যমণি । এইভাবে ভারত ঠান্ডা লড়াইয়ের বাইরে নির্জোট তৃতীয় বিশ্ব গঠনের পথে এগিয়ে যায় ।

[4 ] হাঙ্গেরি সমস্যায় ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত আক্রমণ এবং ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক কয়েকজন হাঙ্গেরীয় নেতার মৃত্যুদণ্ডের ঘটনায় ভারত প্রতিবাদ জানায় । হাঙ্গেরি - সংকট নিরসনে ভারত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে বিশেষ সক্রিয়তা প্রদর্শন করে । 

> জেটিনিরপেক্ষতার ব্যর্থতায় :

 [ 1 ] ভারতের নির্জোট নীতি কিন্তু চিন ও ভারতের মধ্যে বিরোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায় । ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিব্বতীয় ধর্মগুরু দলাই লামাকে ভারতে আশ্রয়দান এবং দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়ায় চিনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাকে কেন্দ্র করে ভারত - চিন বিরোধ সৃষ্টি হয় । ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ২০ অক্টোবর চিন ভারত আক্রমণ করে , আবার ২০ নভেম্বর একতরফাভাবেই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে । কিন্তু এখনও পর্যন্ত চিন বিভিন্নভাবে যুদ্ধের পটভূমি প্রস্তুত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ।

[ 2 ] কাশ্মীর প্রশ্ন , পাক - ভারত আন্তর্জাতিক সীমানা - বিরোধ ইত্যাদি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ককে তিক্ত করে তোলে । ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে নেহরু নুন চুক্তি ( Nehru - Noon Treaty ) দ্বারা ভারত বেরুবাড়ি অঞ্চলের একটা অংশ পাকিস্তানের হাতে তুলে দিলেও সীমানা বিরোধ থামেনি । ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান কচ্ছ সীমান্তের কিছু অঞ্চল অধিকার করলে পাক - ভারত যুদ্ধ শুরু হয় । পরে নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি হয় । এরই প্রেক্ষিতে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের মধ্যস্থতায় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও পাক প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের মধ্যে তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । উভয়পক্ষই প্রাক্ - যুদ্ধবিরতি সীমারেখা মেনে নেয় । যদিও জঙ্গিগোষ্ঠীগুলিকে প্রচ্ছন্ন মদত দিয়ে পাকিস্তান আজও ভারতবিরোধী কার্যকলাপে সদা সচেষ্ট ।

 *জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের গুরুত্ব :


 [1]  জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন এশিয়াআফ্রিকার নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগোষ্ঠীর নবলব্ধ স্বাধীনতাকে রক্ষা করে তাদের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের প্রয়াসকে অব্যাহত রাখতে সাহায্য করে।

[2]  দ্বিমেরুকরণ রাজনীতির মাঝে তৃতীয় বিশ্বের আবির্ভাব ঘটিয়ে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন বিশ্ব রাজনীতিতে ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

[3]  বর্ণবৈষম্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও আণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে এই আন্দোলন বিশ্বে শান্তিপ্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

[4]  এই আন্দোলন বিশ্বে সোভিয়েত র্য মার্কিন জঙ্গি আগ্রাসনকে যে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল তাতে সন্দেহ নেই। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের এ এক ব্যতিক্রমী সাফল্য।

 [5] এই আন্দোলন শক্তিশালী হওয়ার আগে পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলিই বিশ্বরাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করত। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্যই ছিল শেষ কথা। কিন্তু এই আন্দোলন তৃতীয় বিশ্বের সদ্য স্বাধীন, দরিদ্র ও অনুন্নত দেশ ও জাতিগুলিকে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছে।