*জোটনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা ও অর্থ ( Definition and meaning of the Non alignment ) :
অধিকাংশ পশ্চিমি বিশেষজ্ঞরা জোটনিরপেক্ষতা বলতে বোঝান শুধুমাত্র নিরপেক্ষতা বা নিরপেক্ষতাবাদকে , যা যথার্থ নয় । জোটনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে জে . ডব্লিউ . বার্টন ( J. W. Burton ) বলেছেন , জোটনিরপেক্ষতা বলতে বোঝায় সমাজতান্ত্রিক জোট ও ইঙ্গ - মার্কিন পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর প্রভাব থেকে দূরে সরে থেকে বিদেশনীতি নির্ধারণ ও পরিচালনা করা । পশ্চিমি ভাষ্যকাররা দুই শক্তিজোট থেকে সমদূরত্বের নীতি গ্রহণকে নির্জোট ব্যবস্থা বলে থাকেন ।
নির্জোট আন্দোলনের রূপকার ও প্রথম প্রবক্তা জওহরলাল নেহরু এর ইতিবাচক দিকটি বোঝাতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছিলেন যে জোটনিরপেক্ষতার অর্থ নির্লিপ্ততা নয় , স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রয়োজনে যুদ্ধবাদী অশুভশক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করা । দুই বিশ্ব শক্তির দ্বারা চালিত ঠান্ডা লড়াই - এর বিরুদ্ধে তৃতীয় বিশ্বের প্রতিবাদ ঘোষিত হয়েছিল জোটনিরপেক্ষতার নীতির মাধ্যমে ।
*জোটনিরপেক্ষতার সূচনা ( Initiation of Non - alignment ) :
বিশ্বরাজনীতিতে এশিয়া , আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার নবজাত স্বাধীন দেশগুলির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল Non - alignment বা জোটনিরপেক্ষতার ধারণাকে বাস্তবায়িত করে তোলা । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়ে যখন ঠান্ডা লড়াই - এর উত্তেজনা তুঙ্গে উঠেছিল এবং বিশ্ব দুটি বিবদমান শক্তিজোটে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল সেই সময় শান্তিকামী তৃতীয় বিশ্ব থেকে উঠে এসেছিল জোটনিরপেক্ষতার ধারণা । তৃতীয় বিশ্ব কার্যত , নিজের অস্তিত্বের স্বার্থে ঠান্ডা লড়াই - এর সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বিকল্প হিসেবে গড়ে তুলেছিল জোটনিরপেক্ষ বা নির্জোট আন্দোলনকে ( Non - aligned Movement বা NAM ) জোটনিরপেক্ষ নীতির প্রথম ইঙ্গিত মিলেছিল নেহরুর উদ্যোগে ১৯৪৯ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্মেলনে যেখানে এশিয়ার সদ্যস্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলিকে নিয়ে একটি মঞ্চ গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয় । ১৯৫৫ সালের এপ্রিল মাসে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং - এ অনুষ্ঠিত একটি ঐতিহাসিক সম্মেলনে এশিয়া ও আফ্রিকার ২৬ টি দেশের প্রতিনিধিরা মিলিত হন । ঐ সম্মেলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন নেহরু । ঐ সম্মেলনস্থল থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল এবং উপস্থিত রাষ্ট্রপ্রধানরা নির্জোট নীতিকে তাঁদের বিদেশনীতির প্রধান অভিমুখ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন ।
*জোটনিরপেক্ষতার ধারণার পথপ্রদর্শক :
প্রথম পর্বের নেতৃস্থানীয়রা ছিলেন যথাক্রমে তৃতীয় বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ও ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং যুগোশ্লাভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান টিটো , মিশরের রাষ্ট্রপতি নাসের , ঘানার প্রেসিডেন্ট নক্রুমা , ইন্দোনেশিয়ার কর্ণধার সুকর্ন প্রমুখ ।
* বান্দুং সম্মেলনে গৃহীত নির্জোট নীতিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল :
- মানুষের মৌলিক অধিকার ও রাষ্ট্রসংঘের সনদে বিধৃত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন , সকল রাষ্ট্রের সার্বভৌম অধিকার ও ভৌমিক অখণ্ডতাকে স্বীকৃতিদান , অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা ,
- কোনো বৃহৎ শক্তির প্রতিরক্ষা বিষয়ক স্বার্থসিদ্ধি করা থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি ।
- রাষ্ট্রগুলি অন্যান্য দেশের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করবে , কোনো সামরিক জোটের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে না ইত্যাদি । এইসব নীতি ও কর্মপদ্ধতিকে সামনে রেখে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল এবং বিশ্বরাজনীতিতে এক নতুন যুগের অভ্যুদয় ঘটেছিল ।
* জোটনিরপেক্ষতার বৈশিষ্ট্যসমূহ ( Characteristics of Non - alignment ) :
জোটনিরপেক্ষতা ও তার থেকে শুরু হওয়া নির্জোট আন্দোলনের মুখ্য বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল নিম্নরূপ :
১. সামরিক জোটের বিরোধিতা :
নির্জোট দেশসমূহ NATO , SEATO , CENTO ও ওয়ারশ চুক্তির মতো সবধরনের সামরিক জোটের বিরোধী ছিল । তারা অস্ত্র প্রতিযোগিতার ইঁদুরদৌড়ে শামিল হয়নি । সামরিক জোট ও অস্ত্র প্রতিযোগিতাজনিত যুদ্ধ - উন্মাদনা জোটনিরপেক্ষ দেশগুলিকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল ।
২. ঠান্ডা লড়াই - এর বিরুদ্ধাচরণ :
নির্জোট আন্দোলন তাঁর সূচনালগ্ন থেকে ঠান্ডা লড়াই - এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল । জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি আমেরিকা ও সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন পরস্পরবিরোধী শক্তিজোটের মধ্যে চলতে থাকা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকে নিজেদের নিরাপদ দূরে সরিয়ে রাখতে সচেষ্ট ছিল । ঠান্ডা লড়াই - এর প্রশমনেও অনেকসময় তারা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে , যা ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে ।
৩. মতাদর্শগত মেরুকরণের বিরোধিতা :
জোটনিরপেক্ষতা সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মধ্যেকার মতাদর্শগত মেরুকরণ ও বিভাজনে কোনোভাবে আস্থাশীল ছিল না । নির্জোট দেশগুলি মনে করত মতাদর্শগত কট্টর অবস্থান নমনীয়তার ঘোর শত্রু শান্তির পরিপন্থী । ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের রাষ্ট্র জোটনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করেছিল NAM আন্দোলনে শামিল হয়েছিল ।
৪. উন্নয়নের নিজস্ব পন্থা অবলম্বনঃ
নির্জোট দেশগুলি দুটি পরাক্রমশালী শক্তিজোটের অর্থনৈতিক , সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হুবহু গ্রহণ করতে রাজি ছিল তারা নিজেদের মতো করে অর্থনীতি , রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজ গড়ার কাজে মনোনিবেশ করেছিল । এই প্রক্রিয়ায় অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে ও স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে তারা বদ্ধপরিকর ছিল । এই সূত্রে মিশ্র অর্থনীতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ।
৫. মিত্রতা ও সমতা :
জোটনিরপেক্ষতার অপর বৈশিষ্ট্য ছিল দেশে দেশে ও জাতিতে জাতিতে মিত্রতা ও সমতার ভিত্তিতে নতুন সম্পর্ক তৈরি করা । আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্ব ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ওপর জোটনিরপেক্ষতা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল । ৬. রাষ্ট্রসংঘকে সমর্থন ঃ নির্জোট দেশসমূহ সর্বদা রাষ্ট্রসংঘকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করেছে শক্তিশালী হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে । বৃহৎ শক্তিগুলির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে তারা বিশ্বশান্তি সুনিশ্চিত করার প্রয়োজনে রাষ্ট্রসংঘের নীতি ও কর্মসূচিকে সর্বতোভাবে সহায়তা জুগিয়ে এসেছে । এই আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংগঠনটিকে গণতান্ত্রিক করে তুলতেও তারা সচেষ্ট থেকেছে ।
যাইহোক , জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অবদান এবং বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর তার প্রভাব ছিল এককথায় যুগান্তকারী । বিশ্বশান্তি অক্ষুণ্ণ রাখার প্রশ্নে ঠান্ডা যুদ্ধের ও দ্বি - মেরুতার রাজনীতির অবসানে , উপনিবেশবাদের উপসংহারে , জাতিবিদ্বেষ ও বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে , সামরিক জোট ব্যবস্থা ও অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণায় NAM বা নির্জোট আন্দোলন তার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল এবং আজও পালন করে আসছে । দেশে দেশে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় রাষ্ট্রসংঘকে শক্তিশালী করে তোলার কাজেও ‘ ন্যাম ' - এর ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
*NAM- এর শিখর সম্মেলনসমূহ :| স্থান | বছর | অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা |
|---|---|---|
| 1. বান্দুং ( ইন্দোনেশিয়া ) | ১৯৫৫ | ২৬ |
| 2. বেলগ্রেড ( যুগোশ্লাভিয়া ) | ১৯৬১ | ২৫ |
| 3. কায়রো ( মিশর ) | ১৯৬৪ | ৮৭ |
| 4. লুসাকা ( জাম্বিয়া ) | ১৯৭৪ | ৫৪ |
| 5. আলজিয়ার্স ( আলজিরিয়া ) | ১৯৭৩ | ৭৬ |
| 6. কলম্বো ( শ্রীলঙ্কা ) | ১৯৭৬ | ৮৬ |
| 7. হাভানা ( কিউবা ) | ১৯৭৯ | ৯৮ |
| 8. দিল্লি ( ভারত ) | ১৯৮৩ | ৯৯ |
| 9. হারারে ( জিম্বাবোয়ে ) | ১৯৮৬ | ১০০ |
| 10. বেলগ্রেড ( যুগোশ্লাভিয়া ) | ১৯৮৯ | ১০৩ |
| 11. জাকার্তা ( ইন্দোনেশিয়া ) | ১৯৯২ | ১০৮ |
| 12. কার্টাজেনা ( কলম্বিয়া ) | ১৯৯৫ | ১১৩ |
| 13. ডারবান ( দক্ষিণ আফ্রিকা ) | ১৯৯৮ | ১১৩ |
| 14. কুয়ালালামপুর ( মালয়েশিয়া ) | ২০০৩ | ১১৬ |
| 15. হাভানা ( কিউবা ) | ২০০৬ | ১১৬ |
| 16. সার্ম আল শেখ ( মিশর ) | ২০০৯ | - |
