*প্রাচীন ভারতের নারী অবস্থান
ভূমিকা :-প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় বিভিন্ন যুগের সমাজে নারীর মর্যাদার উন্নতি বা অবনতি যাই ঘটুক না কেন, প্রাচীন যুগে নারীর অবস্থান নানা সময়ে বদলেছে. ‘পুরাণ’, ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, ‘মনুস্মৃতি’, ‘যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি’, বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র', মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা’, বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’, কালিদাসের 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম' প্রভৃতি প্রাচীন সাহিত্যেও নারীর অবস্থানের পরিচয় মেলে.
1.প্রাচীন ভারতে নারী অবস্থান
👉(ক) ঋগবৈদিক যুগের নারী (খ্রিস্টপূর্বাব্দ 1800/1500-1000 খ্রিস্টপূর্বাব্দ ):
*পুরুষের ওপর নির্ভরশীলতা: ঋগ্বৈদিক সমাজে বিয়ের আগে বাবা বা ভাই আর বিয়ের পর স্বামী বা ছেলের তত্ত্বাবধানে মেয়েদের জীবন কাটত.
* বিবাহরীতি : ঋগ্বৈদিক সমাজে পতি নির্বাচনে মেয়েরা স্বাধীনতা ভোগ করত. বিবাহের সময় পানি-গ্রহন এবং সপ্তপদী দুটি আচার ছিল অপরিহার্য .বহুবিবাহের প্রচলন না থাকলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের একাধিক স্ত্রীর উল্লেখ দেখা গেছে. অভিজাত পরিবারের বাইরে সতীদাহ প্রথার প্রচলন ছিল না। বিধবাবিবাহের চলও, তবে স্বামীর মৃত্যুতে নিঃসন্তান স্ত্রী দেওরকে বিয়ে করতে পারতেন.
* গৃহস্থালি পরিচালনায় স্ত্রীর ভূমিকা: ঋগ্বৈদিক সমাজে গৃহস্থালির ব্যাপারে স্ত্রী-ই ছিলেন সর্বময় কর্ত্রী. বৃহৎ সংহিতায় উল্লেখ রয়েছে যে, নারীরা ছিলেন গৃহলক্ষ্মী. পরবর্তী সময়ে বাৎস্যায়ণের কামসূত্রে বলা হয়েছে যে, গৃহবধুরূপে নারীকে বাড়ির সকল কাজ করতে হত.
*গৃহের বাইরে মেয়েদের ভূমিকা : সেই যুগে সামাজিক উৎসব-অনুষ্ঠানে অবাধে যোগ দেওয়ার এমনকি যুদ্ধে অংশগ্রহণের অধিকারও তাঁদের ছিল.
* ধর্মীয় কাজে মেয়েদের ভূমিকা: ধর্মীয় কাজে স্ত্রীরা স্বামীকে সাহায্যে করতেন। তাই তাঁদের বলা হত সহধর্মিনী। সে যুগে লোমশা, জুহু, পৌলমী ও কামায়নীয় এর মতো মেয়েরা ধর্মীয় সাধনাতে সাফল্য দেখিয়েছিলেন।
👉(খ) পরবর্তী বৈদিক যুগের নারী (1000-600 BC):
পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীর সামাজিক মর্যাদা অনেকখানি হ্রাস পেয়েছিল।
* কন্যাসন্তানের প্রতি অনীহা: পরবর্তী বৈদিক যুগে পরিবারে কন্যাসন্তানের জন্ম কেউ চাইত না। অনেকক্ষেত্রে তাদের সম্পত্তির অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হত। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে উল্লেখ রয়েছে যে, কন্যা হল অভিশাপ। তাই এসময় কোনো নারী সন্তান সম্ভবা হলে তার গর্ভস্থ সন্তানটিকে পুত্র হিসেবে পাওয়ার জন্য পুংসবন অনুষ্ঠান করা হত।
*বিবাহরীতির পরিবর্তনে নারীর অধিকার লোপ: পরবর্তী বৈদিক যুগে বাল্যবিবাহ, পুরুষের বহুবিবাহ ও পণপ্রথা নারীর জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। রাজপরিবারে বহুবিবাহের ফলে মহিনী অর্থাৎ প্রধান রানি এবং বাবার্তা অর্থাৎ রাজার প্রিয়তমা বাদে বাকি রানিরা ছিলেন অবহেলা ও অনাদরের পাত্রী।
বিবাহের আটটি রূপ ----------
(i) ব্রহ্মা =যথাযথ যৌতুক সহ একই শ্রেণীতে বিবাহ
(ii) দৈব=কন্যা গৃহকর্তা তার পারিশ্রমিকের অংশ হিসাবে পুরোহিত কর্তৃক প্রদত্ত যজ্ঞের জন্য
(iii) অর্সা = বর এই বিয়েতে মেয়ের বাবা-মাকে একটি গরু এবং একটি ষাঁড় উপহার দেয়।
(iv) প্রজাপতি=মেয়ে যৌতুক ছাড়াই বিয়ে করেছে।
(v) গন্ধর্ব = মেয়ে বা মহিলাকে প্রায়ই গোপনে কিনে বিয়ে kora
(vi) অসুর =একটি ইচ্ছুক পুরুষ এবং মহিলাদের বিয়ে প্রায়ই গোপন.
(vii) রাক্ষস = মেয়েকে ধরে নিয়ে বিয়ে।
(viii) পয়সাচ= (মদ্যপ অবস্থায় বিয়ে) মেয়েটি ঘুমন্ত অবস্থায়, মাতাল অবস্থায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অর্থাৎ তার পূর্ণ জ্ঞানে না থাকা অবস্থায় তাকে অপহরণ করে বিয়ে।
*নারীর রাজনৈতিক অধিকার হ্রাস: ঋবৈদিক যুগে নারীরা সভার অধিবেশনে যোগ দিত কিন্তু 'মৈত্রায়ণী সংহিতা' থেকে জানা যায়, পরবর্তী বৈদিক যুদ্ধে তাদের সেই অধিকার খর্ব করা হয়।
*ধর্মাচরণে নারীর অধিকার সংকোচন: ঋগ্বৈদিক যুগে গৃহের যেসব ধর্মীয় কার্য স্ত্রীই পরিচালনা করতেন, পরবর্তী বৈদিক যুগে সেইসব কাজের দায়িত্ব পুরোহিত শ্রেণির হাতে চলে যায়। নারীরা বেদ পাঠের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। মৈত্রায়ণী সংহিতায় নারীকে মদ ও পাশার মতো সর্বনাশা বলে নিন্দা করা হয়েছে। জন্মলগ্ন থেকেই মেয়েদের অধিকারহীনতার লাঞ্ছনা ভোগ করতে হত। তাঁদের জাতকরণ, নামকরণ এবং চূড়াকরণ অনুষ্ঠানে বেদমন্ত্র উচ্চারিত হত না অথচ পুত্রদের ক্ষেত্রে বেদমন্ত্র আবশ্যিক ছিল। যাজ্ঞবল্ক্য মেয়েদের উপনয়ন নিষিদ্ধ করেছেন। শিক্ষার্থীর জ্ঞানরাজ্যে প্রবেশের ছাড়পত্র ছিল এই উপনয়ন। মনু ও যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন, মেয়েদের বিবাহই হল উপনয়ন, পতিগৃহে বাসই গুরু সান্নিধ্য।
👉(ঘ) মৌর্যযুগের নারী:
*সম্পত্তির অধিকার: মৌর্য যুগে নারীরা সম্পত্তির অধিকার পেত। অর্থশাস্ত্র দুইধরনের স্ত্রীধনের কথা বলা হয়েছে। যথা—বৃত্তি (জীবিকা চালানোর উপায়) এবং আবন্ধ্য (আভরণ ও অলঙ্কারাদি)। বৃত্তি হল আসলে ভূমি (কৃষিযোগ্যজমি) এবং হিরণ্যাদি (নগদ টাকাকড়ি)
* বিবাহ ও নারী: এ যুগে স্বামী মারা গেলে স্ত্রী শ্বশুরের অনুমতি না নিয়ে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পারতেন। স্বামী দুশ্চরিত্র বা চিরপ্রবাসী বা ক্লীব হলে নারী সেই স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতে পারতেন। স্ত্রী পরপর কন্যার জন্ম দিলে আট বছর অপেক্ষার পর স্বামী তাকে ত্যাগ করতে পারতেন। যদিও এক্ষেত্রে স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হত স্বামীকে। মেগাস্থিনিস তার ইন্ডিকা গ্রন্থে লিখেছেন সমাজের অসহায় ও নারীদের প্রচুর কষ্টভোগ করতে হত।
* গার্হস্থ্য জীবন : গৃহে তারা বিভিন্ন হস্তশিল্পের কাজও করত। গৃহে অতিথি এলে তার সেবা করা ছিল নারীর প্রধান কর্তব্য। গৃহলক্ষ্মীর ভূমিকা সামলানোর পাশাপাশি নারীরা স্বামীর সঙ্গে বিভিন্ন যজ্ঞানুষ্ঠানেও যোগ দিতে পারত।
👉(ঙ) মৌর্য-পরবর্তী যুগের নারী:
*বিবাহ রীতি: মৌর্য পরবর্তী যুগের সমাজে নারীর বিবাহরীতি নিয়ে বেশ কিছু পরস্পরবিরোধী মত রয়েছে। ‘মনুস্মৃতিতে’ নির্দেশ আছে যে, নারী প্রথম জীবনে পিতার, বিবাহের পর স্বামীর ও পরবর্তী জীবনে পুত্রের অধীনে বার্ধক্য জীবন কাটাবে। মৌর্যোত্তর সমাজে 'অনুলোম'(অনুলোম বিবাহ যেখানে স্ত্রী নিম্নবর্ণের হয়) ও ‘প্রতিলোম'(প্রতিলোমা বিবাহ যেখানে স্বামী নিম্নবর্ণের,)—এই দুই বিবাহরীতির প্রচলন ছিল।
*গার্হস্থ্য জীবণ: মৌর্য পরবর্তী সময়কালে নারীদের স্বামীর গৃহে মিলেমিশে থাকতে হত এবং গৃহের কাজ করতে হত। এ যুগে স্ত্রীকে সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনতে হত। স্বামী ছাড়াও শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করা, দাসদাসীদের কাজের তদারকি করা, গৃহ পরিষ্কার রাখা তাদের অন্যতম কর্তব্য ছিল
👉(চ) গুপ্তযুগের নারী:
*ধর্মীয় অধিকার : গুপ্ত যুগে কেবল স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে স্ত্রী বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, উৎসব ও ধর্মীয় শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারত।
*বিবাহরীতি: গুপ্ত যুগে মেয়েদের সবর্ণে বিবাহে পাশাপাশি স্বামী নির্বাচনেরও অধিকার ছিল। এ যুগে বিধবাবিবাহের প্রচলন থাকলেও সতীদাহ প্রথার চল ছিল না।
*সম্পত্তির অধিকার: মনুস্মৃতি এবং মহাকাব্য দুটিতে নারীর সম্পত্তির অধিকার স্বীকার করা হলেও সামগ্রিকভাবে এ যুদ্ধে নারীর সামাজিক অবস্থানের অবনমন ঘটেছিল। বিধবাস্ত্রী পুনরায় বিবাহ করলে স্ত্রী ধন থেকে বঞ্চিত হত।
*দেবদাসী প্রথা: গুপ্তযুগে ভারতীয় সমাজে এমন কিছু নারী ছিল যাদের গণিকা ও দেবদাসী পর্যায়ে ফেলা হত। এ যুগে দেবদাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
3.নারী শিক্ষা
প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন যুগে ভারতীয় নারীর শিক্ষাগ্রহণের বিষয়টি মটামুটিভাবে অব্যাহত ছিল। বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে পরবর্তী দীর্ঘ সময়ের ভারতের নারীশিক্ষা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায় . একটি বহুল প্রচলিত কথা আছে যে একজন পুরুষকে যখন শিক্ষাদান করা হয় তখন একজন ব্যক্তি শিক্ষিত হয় আর একজন নারীকে শিক্ষাদান করা হলে গোটা পরিবারটিকে শিক্ষিত করা হয়।
👉(ক) ঋগবৈদিক যুগের নারী শিক্ষা:ঋগবৈদিক যুগে নারীশিক্ষারও যথেষ্ট সুযাগ ছিল। উচ্চশিক্ষার সুযোগ তাঁদের যথেষ্ট ছিল। লোপামুদ্রা, বিশ্ববারা, অপালা, ঘোষা প্রভৃতি সে যুগের কয়েকজন বিশিষ্ট মহিলা শিক্ষার উচ্চস্তরে আরোহণ করেছিলেন। তাঁরা ঋগ্গ্বেদের কিছু কিছু মন্ত্রও রচনা করেছেন। সে যুগে লোমশা, জুহু, পৌলোমী ও কামায়নীর মতো মেয়েরা ধর্মীয় সাধনায়ও বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছিলেন
👉(খ) পরবর্তী বৈদিক যুগের নারী শিক্ষা: সামগ্রিকভাবে পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীর মর্যাদা হ্রাস পেলেও নারীশিক্ষা ভালোভাবেই চালু ছিল। এযুগে কোনো কোনো নারী উচ্চশিক্ষায় অগ্রণী ছিলেন। এযুগের যে সকল নারী বিবাহের আগে পর্যন্ত বিদ্যাচর্চা করতেন, তাদের সদ্যোদ্বাহা এবং যারা আজীবন অবিবাহিত থেকে ধর্ম ও দর্শন। চর্চা করে জীবন কাটিয়ে দিতেন, তাঁদের 'ব্রহ্মবাদিনী বলা হত। এ যুগের বিখ্যাত বিদুষী নারী ছিলেন গার্গী, মৈত্রেয়ী প্রমুখ।
👉(গ) প্রতিবাদী ধর্মের যুগের নারী শিক্ষা: মহাকাব্যের যুগে নারীর মর্যাদা হ্রাস পেলেও এযুগের বহু নারী বিদ্যাচর্চা করতেন। মহাভারতে দ্রৌপদীকে 'পণ্ডিতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এযুগের অনেক নারী সামরিক শিক্ষাগ্রহণ করতেন। বিনয়পিটকে বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের অক্ষরজ্ঞান অর্জনকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। এযুগের নারীরা সংস্কৃত কাব্য ও নাটকও রচনা করেছেন। ভিক্ষুণীদের রচিত সংগীত 'থেরীগাথা গ্রন্থে সংকলিত আছে। চন্দনা, জয়ন্তী প্রমুখ ছিলেন এযুগের উচ্চশিক্ষিতা নারী। মহাভারতে অর্জুনের নির্বাসন কালে চিত্রাঙ্গদার নাম আমরা পাই একজন দক্ষ যোদ্ধা হিসেবে। সুভদ্রা ছিলেন একজন দক্ষ রথ চালক বা সারথি
👉(ঘ) মৌর্যযুগের নারী শিক্ষা: মৌর্যযুগে শিক্ষিত নারীরা রাজকার্যেও অংশ নিতেন। সমকালীন সংস্কৃত সাহিত্যে এমন বহু নারীর উল্লেখ আছে যারা লিখতে, পড়তে ও সংগীত রচনা করতে পারতেন। কোনো কোনো নারী চিত্রশিল্পেও দক্ষ ছিলেন। মেগাস্থিনিস তাঁর ‘ইন্ডিকা' গ্রন্থে চন্দ্রগুপ্তের নারী রক্ষীবাহিনীর উল্লেখ করেছেন। কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ থেকে জানা যায় এ যুগের নারীদের অনেকেই নৃত্য, কণ্ঠ ও যন্ত্র সংগীতে অধ্যাপনা করে জীবিকাধারণ করতেন। ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়েদের বিদ্যা অর্জনের যথেষ্ট সুযোগ ছিল।
👉(ঙ) মৌর্য-পরবর্তী যুগের নারী শিক্ষা: মৌর্য-পরবর্তী যুগে অনেক মহিলা উচ্চশিক্ষা লাভ করতেন। পাণিনি বলেছেন যে, এই সময় নারীরা বেদ অধ্যয়ন করতেন। কাত্যায়ণ উপনিষদে বেশ কিছু মহিলা শিক্ষিকার নাম পাওয়া যায়, যেমন—সুলভা, প্রথিতেয়ী, মৈত্রেয়ী, কার্যকাশিনী ইত্যাদি। পাণিনির লেখাতেও “ছাত্রীশালা” (ছাত্রীদের জন্য বাসস্থান) “আচার্যিনী” অর্থাৎ মহিলা শিক্ষিকার উল্লেখ দেখা যায়। এই সময়ে অনেক অভিজাত মহিলা বৈদিক স্তোত্র, সংস্কৃত কাব্য ও নাটক রচনা করতেন।
👉(চ) গুপ্তযুগের নারী শিক্ষা: বিভিন্ন সাহিত্য থেকে গুপ্তযুগের নারীরা, ইতিহাস ও কাব্যচর্চা করত বলে সমকালীন সাহিত্য থেকে জানা যায়। শাসম্ত্রজ্ঞান এযুগের নারীর বাধবুদ্ধিকে তীক্ষ করত বলে ব্যাৎসায়ন উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, আদর্শ পত্নীকে সুশিক্ষিতা হতে হবে এবং তাঁকে সাংসারিক আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখতে হবে। গুপ্তযুগে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা প্রভাবতী গুপ্তার মত কাশ্মীর, উড়িষ্যা ও অন্ত্রের নারীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা করতেন। অবশ্য এযুগে সাধারণ দরিদ্র নারীদের শিক্ষার সুযােগ বিশেষ ছিল না।
👉(ছ) হর্ষবর্ধনের আমলের নারী শিক্ষা: হর্ষবর্ধনের আমলে চিত্রকলা, নৃত্য, সংগীত প্রভৃতি শিক্ষার প্রচলন ছিল। হর্ষবর্ধনের ভগ্নি রাজ্যশ্রী নিয়মিত সংগীত, নৃত্য ও অন্যান্য কলার চর্চা করতেন বলে বানভট্ট উল্লেখ করেছেন। নারীরা সাধারণত পিতৃগৃহেই শিক্ষালাভ করত।
4. নারী অধিকার
প্রাচীন ভারতীয় পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার কম ছিল। নারীর অর্থনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে শাস্ত্রকারদের নীরবতা বা নানা বিধিনিষেধের মধ্যেও তারা নারীকে কিছু অর্থনৈতিক অধিকার অর্থাৎ সম্পত্তি রাখার অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছেন। নারীর এই সম্পত্তি ‘স্ত্রীধন’ নামে পরিচিত।
প্রাচীন ভারতীয় নারী কিছু অর্থনৈতিক অধিকার ভোগ করার অধিকারী ছিল। মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, নারদ, বৃহস্পতি, কাত্যায়ন প্রমুখ শাস্ত্রকার নারীর বিভিন্ন ধরনের সম্পত্তি বা স্ত্রীধনের উল্লেখ করেছেন।
মনুসংহিতা: ‘মনুসংহিতা’য় ছয়টি স্ত্রীধনের উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা—(i) অধ্যগ্নি, (iii) অধ্যবাহনিক, (iii) প্রীতিদত্ত, (iv) পিতৃদত্ত, (v) মাতৃদত্ত ও (vi) ভ্রাতৃদত্ত। বিবাহকালে অগ্নিকে সাক্ষী করে প্রদত্ত সম্পদকে ‘অধ্যগ্নি’ বলে। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের প্রীতির দানকে বলে ‘প্রীতিদত্ত’। পতিগৃহ যাত্রাকালে কন্যাকে দেওয়া সম্পদকে ‘অধ্যবাহনিক’ বলে। পিতা, মাতা ও ভ্রাতার দেওয়া উপহার হল যথাক্রমে ‘পিতৃদত্ত’, ‘মাতৃদত্ত’ ও ‘ভ্রাতৃদত্ত’।
5.উদ্দেশ্য
*প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে নারীদের ও আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়
*ধর্মচর্চা, চরিত্রগঠন, ব্যক্তিত্বের বিকাশ প্রভৃতি ছিল এই যুগের শিক্ষার উদ্দেশ্য।
*সমাজের সামগ্রিক শিক্ষার মান, সুস্থ অবস্থান এবং অগ্রগতির জন্য নারী শিক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
*শিক্ষার মাধ্যমেই নারীর সামাজিক অবস্থানের উন্নতি ঘটানো যায়
*ভারতের ইতিহাস অনুসরণ করে আমরা দেখতে পাই যে নারী শিক্ষা নানা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে এসেছে।
7. ঐতিহাসিক
মতামত
1.অবশ্য ড. এ. এল. বাসাম- মনে করেন যে, সম্পত্তিতে নারীর অধিকার সংকুচিত হলেও অন্যান্য সভ্যতার তুলনায় ভারতীয় নারীর এই অধিকার অনেক বেশি ছিল।
2.অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও মর্যাদা লাভে বঞ্চিত হয়ে নারীসমাজ তখন এক অসম্মানিত সম্প্রদায় হিসেবে জীবন কাটাতে বাধ্য হত বলে -ড. সুকুমারী ভট্টাচার্য মনে করেন।
3.জি. এফ. ইলিন, ওয়াল্টার ব্যুবেন, ডি. ডি. কোশাম্বী প্রমুখ মনে করেন যে, সমকালীন পরিস্থিতি ও অর্থনীতির ওপর নারীর ভাগ্য নির্ধারিত হত।
4. এম. উইন্টারনিজ, আর. ফিক, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ মনে করেন যে, প্রতিটি যুগের ধর্মব্যবস্থা নারীর তৎকালীন সামাজিক অবস্থানকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল।
5. অবশ্য ড. এ. এল. বাসাম মনে করেন যে, সম্পত্তিতে নারীর অধিকার সংকুচিত হলেও অন্যান্য সভ্যতার তুলনায় ভারতীয় নারীর এই অধিকার অনেক বেশি ছিল।
6. উপসংহার
প্রাচীন ভারতীয় সমাজে যুগে যুগে নারীর সামাজিক অবস্থান বদলেছে। আধুনিক ইতিহাসচর্চায় নারীর সামাজিক অবস্থান, বিশেষ করে প্রাচীন সমাজে নারীর বিবাহরীতি সম্বন্ধীয় নানা প্রসঙ্গ আলোচিত হয়।
সম্পত্তিতে নারীর যতটা অধিকারের কথা স্মৃতিশাস্ত্র গুলিতে দেওয়া হয়েছে তা বাস্তবে কতটা কার্যকরী হত তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, সমাজের উচ্চস্তরের নারীরা এবিষয়ে যতটা অধিকার ভোগ করত নিম্নস্তরের নারীরা ততটা পেত না।
নারীর উপনয়ন নেই বলে নারী হোম করতে পারত না। গৌতমধর্মসূত্রে রয়েছে,‘অস্বতন্ত্রা ধর্মে স্ত্রী।’ অর্থাৎ ধর্মবিষয়ে নারীর কোনও স্বাতন্ত্র নেই!
মনু বলেছেন, "যত্র নার্যস্তু পয়জ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ। / যত্রৈতাস্তুন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রফলাঃ ক্রিয়া।" অর্থাৎ যেখানে নারী পূজিতা, সেখানে দেবতাও খুশি হন, যেখানে তাঁদের পূজা নেই, সেখানে সকল ধর্মকর্মই নিস্ফল
![]() |
| প্রাচীন ভারতের নারী অবস্থান |
