সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় 

প্রতিষ্ঠা :

১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে জুলাই আনন্দমোহন বসু , শিবনাথ শাস্ত্রী , দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে প্রায় সাত - আটশ মানুষের উপস্থিতিতে এক বিশাল জনসমাবেশে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ‘ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ' বা ' ভারত সভা ’ - র প্রতিষ্ঠা হয় ।

এই সভা ছিল অধিকতর মধ্যবিত্তভিত্তিক । এর পরিচালক সমিতির সদস্যরা ছিলেন সুশিক্ষিত ব্যারিস্টার , উকিল , সাংবাদিক , শিক্ষক , যাজক , ব্যবসায়ী ও চিকিৎসক । কর্মকর্তাদের মধ্যে | ছিলেন ৩৩ % শিক্ষক , ৩৫ % আইনজীবী এবং তাঁদের মধ্যে অনেকেই বিলেত - ফেরত । এখানে কলকাতার বাইরের লোক এবং ব্রাহ্মদের যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল । এর ৫৪ % কর্মকর্তাই ছিল ব্রাহ্ম । এখানে চাঁদার হার ছিল ৫ টাকা । কৃষক শ্রেণি সম্পর্কেও এই প্রতিষ্ঠান সচেতন ছিল । এখানে কৃষকদের জন্য চাঁদার হার ছিল ১ টাকা । সুরেন্দ্রনাথ ছিলেন এই সভার প্রাণপুরুষ এবং কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় ‘ র‍্যাঙ্গলার ' আনন্দমোহন বসু ছিলেন এর প্রধান উদ্যোক্তা

উদ্দেশ্য ও লক্ষ :

এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ ছিল সর্বভারতীয় রাজনৈতিক আশা হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে দেশে শক্তিশালী জনমত গঠন , আকাঙ্ক্ষাকে ভিত্তি করে ভারতের বিভিন্ন জাতি ও মতাবলম্বী গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করা , ঐক্যবোধ গঠন এবং 4 জনসাধারণকে গণ - আন্দোলনে সামিল করা । সুরেন্দ্রনাথ তাঁর আত্মজীবনীতে ( ' A Nation in Making ' ) লিখছেন যে , “ আমাদের মনে এই চিন্তা কাজ করছিল যে , এই প্রতিষ্ঠান এক সর্বভারতীয় আন্দোলনের কেন্দ্র হোক । ম্যাৎসিনীর প্রেরণা - প্রসূত ঐক্যবদ্ধ ভারত - ভাবনা , অন্তত সমগ্র ভারতকে এক সাধারণ মঞ্চে উপস্থাপন করার ভাবনা , বাংলার ভারতীয় নেতাদের মন আচ্ছন্ন করেছিল । ” বাংলার মফস্বলে এই প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১২৪ টি শাখা স্থাপিত হয় । এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে , এই প্রতিষ্ঠানে কোনো ইউরোপীয় বা জমিদার কর্মকর্তা ছিলেন না — সকলেই ছিলেন উদীয়মান মধ্যবত্তি শ্রেণির প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তি ।

ভারতীয় গণ - আন্দোলন ও জাতীয় জাগরণের ইতিহাসে ‘ ভারত সভা ' এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী । ভারত সভা ' - র আদর্শকে জনপ্রিয় করে তোলার উদ্দেশ্যে সুরেন্দ্রনাথ ঝঞ্ঝার মতো সমগ্র ভারত ভ্রমণ করে সর্বভারতীয় প্রচার কাজে অবতীর্ণ হন । তাঁর বাগ্মিতা ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে লক্ষ্ণৌ , মীরাট , লাহোর প্রভৃতি স্থানের জনসাধারণ ওই সব স্থানে ভারত সভা ' - র শাখা স্থাপন করে । স্যার হেনরি কটন ( Sir Henry Cotton , I.C.S. ) যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে , “ শিক্ষিত সমাজ দেশের কণ্ঠ ও মস্তিষ্ক । শিক্ষিত বাঙালিরা এখন পেশোয়ার থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত জনমত নিয়ন্ত্রণ করছে । ... এখন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম ঢাকা থেকে মুলতান পর্যন্ত যুব সম্প্রদায়ের মনে সমান প্রেরণা জোগায় । ” এই সভা কৃষকদের সমস্যা , সিভিল সার্ভিস , অস্ত্র আইন , ইলবার্ট বিল এবং জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে জনমত গঠন করে ।

এই সভার সদস্যরা বাংলার নানা স্থানে ভ্রমণ করে বেশ কিছু ‘ রায়ত সভা ’ বা ‘ কৃষক সভা ’ প্রতিষ্ঠা করে কৃষকদের জমিদারদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে যত্নবান হন । ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের ‘ রেন্ট অ্যাক্ট ’ ও পাবনা কৃষক বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে এই সমিতি কৃষকদের পক্ষে আন্দোলনে নামে । ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের প্রজাস্বত্ব আইনের খসড়ার বিরুদ্ধে সমিতি প্রতিবাদ জানায় । এছাড়া , সরকারের শোষণ , আমদানি ও শুল্ক আইন , সম্পদের নিষ্ক্রমণ , আসামের চা - বাগানে কুলিদের ওপর অত্যাচার প্রভৃতির বিরুদ্ধে সমিতি প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে ।

সিভিল সার্ভিস ভারতবাসী যাতে উচ্চতর রাজপদে নিযুক্ত হতে না পারে , সেজন্য ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে ফেব্রুয়ারি লর্ড লিটনের শাসনকালে ' সিভিল সার্ভিস ’ পরীক্ষার্থীদের বয়স একুশ থেকে কমিয়ে উনিশ করা হয় । এর প্রতিবাদে সুরেন্দ্রনাথ ও ‘ ভারত সভা ' জনমত গঠন করতে শুরু করে । তিনি ইংল্যান্ড ও ভারতে এই পরীক্ষা গ্রহণ এবং এর ঊর্ধতম বয়স বাইশ করার দাবি জানায় । ১৮৭৭-৭৮ খ্রিস্টাব্দে উত্তর - পশ্চিম প্রদেশ ( বর্তমান উত্তরপ্রদেশ ) , পাঙ্খাব , বোম্বাই মাদ্রাজ ভ্রমণ করে প্রগাঢ় বাগ্মিতা ও তীক্ষ্ণ যুক্তি - তর্কের দ্বারা তিনি ভারতের ব্যাপক অঞ্চলে ওই স্বৈরাচারী আইন - বিরোধী 64 জনমত গঠন ও ‘ ভারত সভা ' - র শাখা স্থাপন করেন । কেবল তাই নয় — ‘ ভারত সভা ' সিভিল সার্ভিস - সংক্রান্ত একটি সর্বভারতীয় আবেদনপত্র রচনা করে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে পেশ করার জন্য প্রখ্যাত বাগ্মী লালমোহন ঘোষ - কে ইংল্যান্ডে পাঠায় । শেষ পর্যন্ত , ইংরেজ সরকার ভারতীয়দের এই দাবি অনেকাংশে মেনে নিয়ে ‘ স্ট্যাটুটারি সিভিল সার্ভিস ' ( Statutory Civil Service ) প্রবর্তনে বাধ্য হয় ।

সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন ' : সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ‘ ভারত সভা ' - র আন্দোলন এক নতুন চেতনার সঞ্চার করে । সুরেন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেন যে , কোনো সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান ব্যতীত সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকরী সংগ্রাম পরিচালনা করা সম্ভব নয় । এই কারণে ‘ ভারত সভা ' - র উদ্যোগে এবং সুরেন্দ্রনাথ ও আনন্দমোহন বসুর চেষ্টায় কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ( বর্তমান কলেজ স্ট্রিট ' কফি হাউস ' ) জাতি - ধর্ম - বর্ণ নির্বিশেষে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় শতাধিক প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘ সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন ' ( ২৮-৩০শে ডিসেম্বর ) -এর আয়োজন করা হয় । রামতনু লাহিড়ি  সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন । তিনদিন ব্যাপী এই সম্মেলনে স্বায়ত্বশাসন , প্রতিনিধিমূলক ব্যবস্থা পরিষদ , সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষা , বৃহত্তর কর্মসংস্থান , বিচার ব্যবস্থার স্বতন্ত্রীকরণ , উচ্চপদে অধিকসংখ্যক ভারতীয় নিয়োগ , অস্ত্র আইন রহিত প্রভৃতি প্রস্তাব গৃহীত হয় । আনন্দমোহন বসু জাতীয় সম্মেলনকে ‘ জাতীয় পার্লামেন্টের দিকে প্রথম পদক্ষেপ ’ ( First stage towards a National Parliament ) বলে অভিহিত করেছেন । ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশন সমাপ্ত হওয়ার পরদিনই ‘ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ' প্রথম অধিবেশন ( ১৮৮৫ ) বসে । জাতীয় কংগ্রেসের উদ্যোক্তাগণ সুরেন্দ্রনাথের কাছ থেকে ‘ জাতীয় সম্মেলনের ' কার্যবিবরণী সংগ্রহ করেন এবং এই অধিবেশনে ‘ জাতীয় সম্মেলন ' - এর অনুকরণেই বিভিন্ন প্রস্তাব পাশ করা হয় । এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে , ' জাতীয় সম্মেলন ' থেকেই ' জাতীয় কংগ্রেস ' - এর অনুপ্রেরণা আসে ।