*আনন্দমঠ ' ( ১৮৮২ খ্রিঃ ) :

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

  পৃথিবীর যে কোনো দেশে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বিকাশের সঙ্গে সেই দেশের দেশাত্মবোধক বা জাতীয়তাবাদী সাহিত্যের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ । উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দেশাত্মবোধক সাহিত্যের বিকাশ ভারত ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । কাব্য , নাটক , উপন্যাস , প্রবন্ধ — সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রেই সেদিন মূল সুর ছিল দেশপ্রেম । ভারতীয় চিত্রকলাতেও সেদিন স্বাদেশিকতার ছোঁয়া লেগেছিল । ভারতীয় জাতীয় জাগরণে এইসব গ্রন্থ এবং চিত্রকলার গুরুত্ব অপরিসীম । '


 *সূচনা : ভারতীয় জাতীয় জাগরণ ও মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে সাহিত্য সম্রাট ’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘ আনন্দমঠ ' উপন্যাস এক অতি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ । উনিশ শতকের শেষ পাদে জাতীয় জীবনের এক ক্রান্তিলগ্নে প্রকাশিত হয়ে এই মহাগ্রন্থটি বাঙালি তথা ভারতবাসীকে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের মহত্তর আদর্শে দীক্ষিত করে ভারত ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করে । আধুনিক ভারতে লিখিত আর কোনো গ্রন্থ সর্বভারতীয় রাজনীতি ও জীবনবাদের ওপর এমন গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল বলে জানা নেই । পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতীয় ভাবোদ্দীপক ও প্রেরণাদাত্রী অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে , কিন্তু দেশপ্রেমের উদ্দাম আবেগে উদ্বেলিত করে সমগ্র জাতিকে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপ দিতে অনুপ্রাণিত করেছে , এমন গ্রন্থের সংখ্যা খুবই কম । ' আনন্দমঠ ' হল এই শ্রেণিরই গ্রন্থ এবং ভাবসম্পদ , চিন্তার ঐশ্বর্য ও গভীরতা এবং বুদ্ধির দীপ্তিতে ‘ আনন্দমঠ ' ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম ' অনুপ্রেরণা রুশোর ‘ সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট ' - এর সমতুল্য

*বিষয়বস্তু : ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিকায় রচিত ‘ আনন্দমঠ ' উপন্যাসে জনজীবনের কোলাহল থেকে দূরে এক নিভৃত স্থানে একটি মঠ গঠনের কথা বলা হয়েছে । এই মঠে বসবাসকারী ত্যাগী সন্ন্যাসীরা দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য নিবেদিত প্রাণ । তাঁদের লক্ষ্য আত্মমুক্তি নয় — দেশমাতৃকার মুক্তি । এই উপন্যাসে তাঁদের মুক্তি সংগ্রামের কাহিনিই বিবৃত হয়েছে । এই কাহিনির মধ্য দিয়ে ‘ সাহিত্য সম্রাট ’ দেশপ্রেমের আদর্শ ও দেশপ্রেমিকদের নীতিবোধকে মুক্তিকামী জাতির সামনে তুলে ধরেছেন । বলতে দ্বিধা নেই যে , বঙ্কিম - প্রদর্শিত কর্মপদ্ধতি ও ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মৃত্যুভয়হীন চিত্তে দেশপ্রেমিকরা মাতৃমুক্তিযজ্ঞে নিয়োজিত হতেন । তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হত ‘ আনন্দমঠ ' - এর অমোঘ বাণী ‘ বন্দেমাতরম ' । ড . রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন যে , “ আর কোনো বাংলা বই বা অন্য কোনো ভাষায় লেখা কোনো বই বাঙালি যুবকদের এত গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ করেনি । ”


*গ্রন্থের আদর্শ : বঙ্কিমচন্দ্র ‘ আনন্দমঠ ' - এর মাধ্যমে দেশপ্রেমিকদের সামনে কয়েকটি নতুন বিশ্বাস ও আদর্শ তুলে ধরেন । তিনি বলেন যে , দেশ নিছক একটি জড় বস্তু নয় । -দেশের মধ্যে চিন্ময়ী সত্তা আছে । ও দেশ আমাদের মা । মঠাধীশ সত্যানন্দ বলেছেন— “ আমরা অন্য মা মানি না – জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী । আমরা বলি , জন্মভূমিই জননী , আমাদের মা নাই , বাপ নাই , ভাই নাই , বন্ধু নাই , পুত্র নাই , ঘর নাই , বাড়ি নাই , আমাদের আছে কেবল সেই সুজলা , সুফলা , মলয়জ সমীরণ শীতলা শস্যশামলা ... ” মা । দেশ আমাদের ঈশ্বর । দেশপ্রেমই ধর্ম এবং ধর্মই দেশপ্রেম । এই ধর্মের নাম ‘ সন্তান ধর্ম ' । ↑ তিনি সন্ন্যাসের এক নতুন আদর্শ তুলে ধরলেন । এতদিন ভারতবাসী ঈশ্বরের সন্ধানে সংসার ত্যাগ করে বনে - জঙ্গলে গিয়ে আত্মমুক্তির কথা চিন্তা করেছে । বঙ্কিমচন্দ্র নতুন সন্ন্যাসী সম্প্রদায় সৃষ্টি করে বললেন যে , সন্ন্যাসীর লক্ষ্য মানুষের মুক্তি , দেশের মুক্তি , দেশহিতৈষণা । আবেদন - নিবেদন নয় — আত্মবিশ্বাস , ক্ষাত্রশক্তি ও আত্মদানের মাধ্যমে দেশমাতৃকার মুক্তি অর্জিত হবে । 6 দেশমাতার মুক্তিযজ্ঞে নারী সমাজকেও সঙ্গে চাই – নারী জাগরণ ছাড়া দেশের মুক্তি সম্ভব নয় । জনজাগরণ চাই । চাই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সমগ্র জাতি । জাতি জাগলে দেশ জাগবে — দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হবে । তাই আপামর জনসাধারণের জাগরণ চাই । ও দেশপ্রেমিকের নীতিবোধ থাকবে — তিনি নিষ্কামভাবে কাজ করবেন । নীতিহীন হলে তাঁর সকল প্রয়াস , সকল ত্যাগ ব্যর্থ হবে । গ্রন্থশেষে মহাপুরুষ সত্যানন্দকে বলছেন— “ পাপের ফল কখনও পবিত্র হয় না । অতএব তোমরা দেশের উদ্ধার করিতে পারিবে না । ” –এ এক চিরন্তন সত্য । উপসংহারঃ ‘ আনন্দমঠ ' - এর আদর্শ যুগ যুগ ধরে পরাধীন জাতির মনে অনুপ্রেরণা যোগাবে । এই গ্রন্থ জাতীয়তার বেদ বাইবেল ও গীতা । এর মূল কথাই হল দেশপ্রেম , বিদ্রোহ , বিপ্লব ও স্বাধীনতা ।

 ' বন্দেমাতরম্ ' সংগীত 

আনন্দমঠ ' উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র রচিত একটি বিখ্যাত সংগীত হল ' বন্দেমাতরম্ ' । বলা হয় যে ‘ বন্দেমাতরম্ ' হল মাতৃবন্দনার মহাসংগীত এবং এই মা হলেন জননী জন্মভূমি দেশমাতৃকা । তিনি হলেন মাতৃভক্ত সন্তানের একমাত্র আরাধ্যা , যার মধ্যে দশপ্রহরণধারিনী দুর্গার শক্তি , কমলদলবিহারিনী কমলার বৈভব এবং বিদ্যাদায়িনী বাণীর জ্ঞানেশ্বর্যের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে । মাতৃভক্ত সন্তানের কল্পনায় শক্তি , সম্পদ ও বিদ্যার অপূর্ব সমন্বয়ে গঠিত এ এক নতুন সৃষ্টি— সকল দেবতার বিশেষ গুণাবলীর মিলন ঘটেছে তার মধ্যে , কিন্তু বিশেষ কোনো দেবতার মধ্যে তিনি নিজেকে বিলীন করে দেন নি । বন্দেমাতরম্ ' হল দেশবন্দনার মহাসংগীত । ' বন্দেমাতরম্ ' ধ্বনি দেশমাতৃকার আহ্বান— দেশমাতৃকার নামে ঐক্যের আহ্বান । এর মধ্যে কোনো বিভেদ , বিচ্ছেদ , সাম্প্রদায়িকতা অন্য দেশ বা জাতির প্রতি বিদ্বেষ নেই । ' বন্দেমাতরম্ ' হল দেশাত্মবোধ ও দেশপ্রেমের মহাসংগীত ।