*তৃতীয় বিশ্বের সংজ্ঞা ও পরিধি :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে দ্বি - মেরুকৃত বিশ্ব ব্যবস্থায় বিশ্বরাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ঠান্ডা লড়াই - এর প্রকোপ বেড়ে চলার প্রেক্ষিতে Third World বা তৃতীয় বিশ্বের উদ্ভব ঘটেছিল । ১৯৫০ - এর দশকে ‘ তৃতীয় বিশ্ব ’ অভিব্যক্তিটি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । সাধারণভাবে তৃতীয় বিশ্ব বলতে বোঝায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়ে ঔপনিবেশিকতার অবসানের সাথে সাথে আত্মপ্রকাশ করা এশিয়া , আফ্রিকা , মধ্য ও লাতিন আমেরিকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলিকে । ১৯৭০ সাল নাগাদ তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে ছিল সমগ্র আফ্রিকার অধিকাংশ দেশসমূহ , চীন বাদে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন ভারত , পাকিস্তান , বাংলাদেশ এবং সমগ্র লাতিন আমেরিকাসহ মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশসমূহ ।এগুলো সবই পূর্বে পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির উপনিবেশ অথবা অধীন রাষ্ট্র ছিল এবং স্বাধীনতা অর্জনের সময় আর্থিক দিক থেকে এগুলি দুর্বল ও অনুন্নত ছিল । 

  • তৃতীয় বিশ্ব ’ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি দুর্ভেয় বিষয় এবং একই সাথে একটি শিথিল ও দুর্বোধ্য ধারণা কেননা এটি কোনো একটি সুসংহত প্রতিষ্ঠান অথবা পরিকল্পিত রাষ্ট্র সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি ।
  • তৃতীয় বিশ্ব ' শব্দবন্ধ প্রথম ব্যবহার  করেন রাষ্ট্রসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব ডাগ হ্যামারশিল্ড ( Dag Hammerskjold ) । তিনি এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার দরিদ্র ও অনুন্নত রাষ্ট্রগুলিকে বোঝাতে ' তৃতীয় বিশ্ব ' শব্দযুগল ব্যবহার করেছিলেন ।
  •  ক্যালভোকোরেসি বলেছেন যে এটি তৃতীয় বিশ্ব ছিল কারণ এই সমস্ত তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলি মার্কিন ও সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত বিশ্বের দ্বিখণ্ডীকরণের ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল ।
  •  মাও সে - তুং অবশ্য ' তৃতীয় বিশ্ব ' সংজ্ঞাটিকে অন্তঃসারহীন বলেছিলেন ।  তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশই শুরু থেকে প্রকৃতিতে জোটনিরপেক্ষ দেশ । 
  • এককথায় , তৃতীয় বিশ্ব ছিল ‘ দরিদ্র , অস্থিতিশীল , নবোদ্ভূত , অ - শ্বেতাঙ্গ এবং দুর্বল ' । উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে ছিল । 

* তৃতীয় বিশ্বের প্রকৃতি , লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং ভূমিকা ( Nature , Goals Objectives and Role of the Third World ) 

 তৃতীয় বিশ্বের প্রকৃতি নিহিত আছে তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে । মূল বৈশিষ্ট্যগুলি নীচে আলোচিত হল ।

  1. কেগলে ও উইটকফ  - এর মতে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা সম্পদ আয়ের বিশ্বজোড়া অসাম্য ও বৈষম্যের নিরিখে তৃতীয় বিশ্বকে চিহ্নিত করেছেন । এঁদের বক্তব্যের মূল নির্যাস হল আবশ্যিকভাবে তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্গত দেশগুলি ছিল বিশ্বের মধ্যে দরিদ্রতর এবং অর্থনৈতিকভাবে কম উন্নত দেশ । বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্গত । কিন্তু GNP ( Gross National Product অনুসারে এগুলি বিশ্বের মাত্র ২০ শতাংশ পণ্য ও পরিষেবা উৎপাদনে সক্ষম । 
  2. পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদে বিভক্ত দুনিয়া থেকে সমদূরত্বের ধারণা দ্বিতীয় বিশ্ব পুঁজিবাদী ও সাম্যবাদী বুনিয়া থেকে সাধারণভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে অভ্যস্ত ছিল  । তৃতীয়  বিশ্ব দুই মহাশক্তির পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত সীমাহীন ক্ষমতা ও অতিপত্তিতে সর্বরা সম্রস্ত থাকত এবং তাই দুই সুপার পাওয়ারের প্রভাবাধীন পরস্পরবিরোধী সামগ্রিক রাজনৈতিক জোটের কোনোটিতেই সে অন্তর্ভুক্ত হতে চায়নি । এই পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্রের বিরোধ তথা পূর্ব - পশ্চিম সংঘাত থেকে সমদূরত্বের নীতি অর্থাৎ জোটনিরপেক্ষতার নীতি ( Policy of non - alignment ) গ্রহণ করেছিল 
  3. দুর্বল , অস্থির , নবগঠিত ও দারিদ্র্য কবলিত তৃতীয় বিশ্বের ধারণার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল আরও এক বিভাজন — উত্তর বনাম দক্ষিণ এই বিভাজন নিহিত ছিল আর্থিক অবস্থা , ক্ষমতা ও সামর্থ্যের তারতম্যের মধ্যে । ঘটনাচক্রে অধিকাংশ ধনী ও উন্নত দেশগুলি উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত এবং তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ দুর্বল ও দরিদ্র দেশসমূহের ভৌগোলিক অবস্থান হল দক্ষিণ গোলার্ধ্য । 

* তৃতীয় বিশ্বের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ( Objectives and Goals of the Third World )

শুরু থেকে  তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি তিনটি সাধারণ উদ্দেশ্য ও একগুচ্ছ লক্ষ্য সামনে রেখে যাত্রা শুরু করেছিল । 

প্রথমত -, ঐ দেশগুলি বিশ্বরাজনীতির আঙিনায় নিজেদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান দৃঢ় করতে ঠান্ডা লড়াই ও দ্বি - মেরুতার রাজনীতি থেকে নিজেদের বিযুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় যা শেষ অবধি নির্জেটি আন্দোলনের সূচনা করেছিল 

দ্বিতীয়ত - , তারা সমস্ত প্রকার ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ ও বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে লড়াই জারি রেখেছিল । 

তৃতীয়ত - , আধুনিকীকরণ , শিল্প - বাণিজ্যের উন্নয়ন ও দ্রুত আর্থিক উন্নয়নের মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্ব জন্মলগ্ন থেকে নিজেকে মেলে ধরতে প্রস্তুতি শুরু করে দেয় । 

*তৃতীয় বিশ্বের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যসমূহ ছিল নিম্নরূপ :

1. এশিয়া , আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নসাধন । তৃতীয় দুনিয়ার রাজনীতিক ও রাষ্ট্রপ্রধানরা বুঝেছিলেন যে প্রযুক্তিগত নির্ভরতা ( technological dependence ) - র কারণে বিশ্ব উন্নয়নের সিঁড়ির শেষ ধাপে উন্নয়নশীল দেশগুলি নেমে গেছে ।

2. ১৯৭০ - এর দশক থেকে তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্গত রাষ্ট্রসমূহ একটি নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নীতি বা New International Economic Order ( NIEO ) - র দাবি উত্থাপন করে চলে । তাদের পরিকল্পিত সেই আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল পুঁজিবাদী বিশ্বের নয়া উপনিবেশবাদ - নির্দিষ্ট ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন । ,

3. তৃতীয় বিশ্বের উত্থাপিত সাম্যের দাবি ক্রমে অর্থনীতি থেকে রাজনীতিতে প্রসারিত হয় । প্রতিটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র এই অবস্থার আমূল পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছিল । তারা নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপের চরম বিরোধিতা করে । সমতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লক্ষ্যে তারা ছিল অবিচল । তৃতীয় বিশ্ব এভাবে প্রাপ্য সম্মান দাবি করেছিল । 

4 . নিজেদের নবলব্ধ স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজনে তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালে পূর্ব - পশ্চিমে বিভক্ত দুনিয়া থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখতে তৎপর হয় এবং জোটনিরপেক্ষতার নিরাপদ বিদেশনীতি গ্রহণ করে । তৃতীয় বিশ্বের মোট ১২২ টি দেশের মধ্যে ১০৩ টি দেশ নিজেদেরকে নির্জোট বা জোটনিরপেক্ষ ঘোষণা করেছিল । 

তৃতীয় বিশ্ব