তৃতীয় বিশ্ব বলতে বুঝায় বিশ্বের প্রধান দুটি সামরিক জোট ন্যাটো এবং ওয়ারশ ভূক্ত নয় এমন রাষ্ট্রগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে বিশ্বে শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধ। 

  1. ন্যাটোর সহযোগী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, পশ্চিম জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন তথা পশ্চিম ইউরোপ; এদের বলা হয় প্রথম বিশ্ব।
  2. সোভিয়েতের পক্ষে থাকা চীন, কিউবা ও তাদের সহযোগীরা হলো দ্বিতীয় বিশ্ব। 
  3. কোনো পক্ষে অংশ না নেওয়া আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, এশিয়া, ওশেনিয়ার দেশগুলি হলো তৃতীয় বিশ্ব । 

*তৃতীয় বিশ্বের ওপর ঠান্ডা লড়াই - এর প্রভাব ( Impact of Cold War on the Third World ) :

 বিশ্বরাজনীতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে অব - উপনিবেশীকরণজনিত তৃতীয় বিশ্বের অভ্যুদয় এবং ঠান্ডা লড়াই - এ সূচনা ও প্রসার একই সাথে সমান্তরালভাবে ঘটেছিল ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে যে ঠান্ডা লড়াই ছিল দুটি মহাশক্তিধর দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন দুটি শক্তিজোটের মধ্যেকার মতাদর্শগত স্নায়ুর লড়াই বা অন্যভাবে বললে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রথম বিশ্ব বনাম দ্বিতীয় বিশ্বের লড়াই । কিন্তু এই স্নায়ুযুদ্ধ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব অর্থাৎ আমেরিকা ও ইউরোপের মাটিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না , তা দ্রুতগতিতে প্রসারিত হয়েছিল এশিয়া , আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত সদ্যস্বাধীন দেশগুলি নিয়ে গঠিত তৃতীয় বিশ্বের বিস্তীর্ণ পরিমণ্ডলে । এই যুদ্ধোন্মাদনা নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল তৃতীয় দুনিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলিকে  বলা হয়ে থাকে , " The Third World was both an observer and a pawn in the cold war .


01. বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত ছোটোমাপের রাষ্ট্রগুলি বিভিন্ন প্রক্রিয়ার পরিণতিতে ক্ষেত্রবিশেষে ঠান্ডা লড়াই - এর অংশীদার হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছিল  । কোরিয়ার যুদ্ধ , কিউবার মিসাইল সংকট , ভিয়েতনাম যুদ্ধ , মধ্যপ্রাচ্যের আরব - ইজরায়েল সংঘর্ষ প্রভৃতি সংকটকে কেন্দ্র করে ঠান্ডা লড়াই - নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছিল যা তৃতীয় দুনিয়াকে বারেবারে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে চলেছিল । 

 02. নিজেদের সদ্য পাওয়া স্বাধীনতাকে যে - কোনো মূল্যে রক্ষা করতে উন্নয়নশীল দেশগুলি বিবদমান দুই মহাশক্তির থেকে সমদূরত্বে থাকাকেই শ্রেষ্ঠ পন্থা বিবেচনা করেছিল । 

03. কদিকে ঠান্ডা লড়াই যেমন তৃতীয় বিশ্বের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল তেমনি এর সুবাদে অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্ব পরোক্ষভাবে অনেকটা সুসংহত রূপ ধারণ করেছিল 

 04. ঠান্ডা লড়াই - এর অস্থির দিনগুলিতেও তৃতীয় বিশ্বের গঠনমূলক ও ইতিবাচক ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে প্রশংসার যোগ্য । 

05. দ্বি - মেরুতা তথা ঠান্ডা লড়াই - এর অবসান বলার অপেক্ষা রাখে না , তৃতীয় বিশ্বকে আরও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে । 

* তৃতীয় বিশ্বের সমস্যাবলি ( Problems of the Third World ) :

তৃতীয় বিশ্বের নিজস্ব সমস্যাগুলিকে তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকে চিহ্নিত করা যেতে পারে । 

01. তৃতীয় বিশ্বের কয়েকটি দেশ ব্যতিরেকে অধিকাংশ দেশেই স্বাধীনতা এসেছিল ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে । এর ফলে তাদের বহু মূল্য দিতে হয়েছিল ও স্বীকার করে নিতে হয়েছিল অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি । বহু প্রাণের বিনিময়ে বৈপ্লবিক সংগ্রামের পরিণতিতে কেনিয়া , মোজাম্বিক , অ্যাঙ্গোলা , আলজিরিয়া ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে স্বাধীনতা এসেছিল । 

02. তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক বিবাদ ও সংঘর্ষ এবং ধর্ম ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক লাগাতার অন্তর্ঘাত ও গৃহযুদ্ধ সেখানে শান্তি ও সুস্থিতি নষ্ট করে এবং আর্থ - সামাজিক উন্নয়নের পথে রীতিমতো বাধা সৃষ্টি করে চলে । 

04. ১৯৪৫ সাল থেকে এইসব দ্বন্দ্ব ও বিরোধের কারণে তৃতীয় বিশ্বের ২০ মিলিয়নের মতো মানুষ নিহত হয়েছিল । তৃতীয় বিশ্বের সংকট বাড়িয়ে চলেছিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো সুপার পাওয়ারের ক্ষমতা প্রদর্শন ও অনায্য হস্তক্ষেপ ।

 05. দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়া , মধ্যপ্রাচ্য ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে মার্কিন সামরিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা ও অতি - সক্রিয়তা সময়ে সময়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল । বিগত শতাব্দীর আশির দশক থেকে বিশ্বব্যাপী মার্কিন তৎপরতা ও নয়া উপনিবেশবাদ নতুন উদ্যমে প্রসারিত হতে থাকলে সংকটের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছিল । পর্বের কৌশলগত মার্কিন হস্তক্ষেপের নীতির উদ্ভাবক ছিলেন তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন ( ১৯৮০ ) এবং সেই আধিপত্যবাদী মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ' রেগন নীতি ’ ( Reagon Doctrine ) নামে পরিচিত ছিল । ব্রেগনের ' Star War ' বা নক্ষত্রযুদ্ধের প্রকল্পও তৃতীয় বিশ্ব জুড়ে আতঙ্কের আবহ তৈরি করেছিল । 

06. তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নের পথে অবশ্য প্রধান বাধা ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা ও অর্থনৈতিক অধীনতা । বিশ্ব ব্যাংক ( World Bank ) ও আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার ( IMF ) - এর মতো সংস্থার ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার পরিস্থিতি ছিল অতীব শোচনীয় ।

 07. নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে বৃহৎ শক্তিবর্গের গড়ে তোলা একাধিক শক্তিজোট তৃতীয় বিশ্বের ওপর ঠান্ডা লড়াইকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে । ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে কমিউনিস্ট চিনকে প্রতিরোধ ও ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট আগ্রাসন রোধ করার উদ্দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা ( SEATO ) | 4 ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে গড়ে তোলা হয় মধ্যপ্রাচ্য প্রতিরক্ষা সংস্থা MEDO ) ( ১৯৫৫ খ্রি . ) । পরবর্তীকালে এই সংস্থারই নাম হয় বাগদাদ চুক্তি বা সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন ( CENTO ) | মধ্যপ্রাচ্যে রুশ আধিপত্য রোধ ও সেখানকার খনিজ তেল সম্পদের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব স্থাপনই ছিল এট প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ।

*পরিশেষ ( Epilogue ) :

এইসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তৃতীয় বিশ্বের ভূমিকা ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছিল । রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে , ' আন্তর্জাতিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে তৃতীয় বিশ্ব ঠান্ডা যুদ্ধের উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে বিশ্বরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ সংকটগুলির সন্তোষজনক সমাধানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল এবং সেই সুবাদে সাফল্যের শরিক হয়েছিল ।  অনেকে আবার একই পর্বে তৃতীয় বিশ্ব থেকে উদ্ভূত চতুর্থ বিশ্ব ( Fourth World ) - র উত্থানের দিকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন ক্যালডোকোরেসি - র মতো ঐতিহাসিকদের মতে ‘ ওপেক ’ ( OPEC ) - এর অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ পশ্চিম এশিয়ার অফুরন্ত তৈলসম্পদ সমৃদ্ধ ধনী আরব রাষ্ট্রগুলি নিয়ে গঠিত ছিল সেই চতুর্থ বিশ্ব । 

তৃতীয় বিশ্ব