কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা
গুপ্ত সাম্রাজ্যবাদী শাসনব্যবস্থা আলোচনার গোড়াতেই জেনে রাখা দরকার যে এক্ষেত্রে শাসকেরা নতুন বা অভিনবত্ব কিছু, ঘটাননি। গুপ্তদের আগে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে বিদেশীয় ও দেশীয় রাজবংশগুলি কর্তৃক প্রচলিত শাসনব্যবস্থার ছককেই তাঁরা একরকম অনুসরণ করেছিলেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পূর্বতন শাসনব্যবস্থার সঙ্গে এর পার্থক্য নিশ্চয়ই ছিল। আলোচনা প্রসঙ্গে দেখা যাবে যে পূর্ববর্তী মৌর্য, কুষাণ বা সাতবাহনদের তুলনায় গুপ্ত শাসকেরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংযোজন ঘটিয়েছিলেন। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৌর্য শাসনব্যবস্থার সঙ্গে গুপ্ত শাসনব্যবস্থার কিছু মৌলিক পার্থক্যও ঘটেছিল। তবে আয়তনের দিক থেকে মৌর্য সাম্রাজ্য ছিল গুপ্ত সাম্রাজ্যের তুলনায় অনেক বড়।
মৌর্য ও সাতবাহন আমলের ন্যায় গুপ্তযুগেও শাসনব্যবস্থার শীর্ষে বিরাজ করতেন সম্রাট। গুপ্ত শাসনব্যবস্থায় রাজার অবস্থান ও মর্যাদা আলোচনা প্রসঙ্গে সম্রাটগণ কর্তৃক উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন অভিধা গ্রহণের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত বলা যায়, সাম্রাজ্যবাদী গুপ্ত শাসকেরা পূর্বতন ভারতীয় বিভিন্ন রাজবংশের শাসকগণ কর্তৃক গৃহীত ‘রাজন’ অভিধা বর্জন করে অপেক্ষাকৃত উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন অভিধা গ্রহণ করেছিলেন, যা এদেশে পূর্বে শাসনরত বিদেশীয় শাসকগণ (ইন্দো-গ্রীক, শক, পার্থিয়ান, কুষাণ) কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পর থেকে সমস্ত গুপ্ত সম্রাটই 'মহারাজাধিরাজ' অভিধা গ্রহণ করেছিলেন, যা তাঁদের শিলালেখ, অভিজ্ঞান মুদ্রা এবং মুদ্রায় উৎকীর্ণ লেখ থেকে বোঝা সম্ভব হয়। এছাড়াও গুপ্তযুগের মুদ্রা ও শিলালেখ থেকে বিভিন্ন ধরনের অভিধা, যেমন—‘রাজাধিরাজ', ‘পরম রাজাধিরাজ', ‘রাজাধিরাজর্ষি' প্রভৃতি সম্রাটগণ কর্তৃক অনুসৃত হবার কথা জানা যায়। ‘মহারাজ' বা 'রাজন’-এই সাধারণ অভিধার পরিবর্তে উচ্চ অভিধা গ্রহণের বিষয়টি নিঃসন্দেহে সাধারণ রাজাদের তুলনায় গুপ্ত শাসকদের অদ্বিতীয় সার্বভৌম শাসকের মর্যাদাকে সূচিত করে। এই সমস্ত অভিধা ছাড়াও সাম্রাজ্যবাদী গুপ্ত শাসকরা আরো অন্যান্য অভিধা গ্রহণ করতেন, যেগুলির মাধ্যমে তাঁদের অতি মানবিক গুণাবলী অথবা ঈশ্বরের সমকক্ষ হিসাবে, নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার মানসিকতা প্রতিফলিত হয়ে উঠত। এ প্রসঙ্গে সমুদ্রগুপ্ত কর্তৃক নিজেকে 'কুবের, বরুণ, ইন্দ্র ও অন্তক
(যম)-র সমকক্ষ বলে প্রতিপন্ন করার কথা উল্লেখ করা যায়। এছাড়া উত্তরবঙ্গে প্রাপ্ত লেখ ও তাম্রশাসনগুলিতে (বিশেষ করে ৪৩৩ খ্রিঃ-৫৪৪ খ্রিঃ পর্যন্ত) গুপ্ত সম্রাটগণ কর্তৃক ‘পরমদৈবত পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ' অভিধা গ্রহণের বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। এই সমস্ত অভিধা গ্রহণ, বিশেষ করে 'পরমদৈবত' অভিধা গ্রহণের বিষয়টি প্রমাণ করে যে গুপ্ত শাসকেরা নিজেদেরকে ভগবানের সমকক্ষ বলে পরিচিতি দিয়ে তাঁদের অতিমানবিক মনোভাবকে মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করতেন। এই সমস্ত আড়ম্বরপূর্ণ অভিধাগুলি থেকে মৌর্যযুগের কয়েক শতক পর রাজতন্ত্রের পুনর্বাসন ঘটানোর প্রয়াস লক্ষ করা যায়। একথা অবশ্য মনে রাখা দরকার যে 'রাজা দেবতার সৃষ্টি মৌর্যযুগের এই ধারণা গুপ্তযুগে পরিত্যক্ত হয়েছিল।
শুধু গুপ্ত শাসনব্যবস্থার শীর্ষে রাজা বিরাজ করতেন তাই নয়, তিনি যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারীও ছিলেন। বৈদিক যুগের সময় থেকে প্রাচীন ভারতবর্ষে ঐতিহ্যগতভাবে সম্রাটরা শাসনতান্ত্রিক ও বিচার বিভাগীয় ক্ষেত্রে যে সর্বময় কর্তৃত্ব ভোগ করতেন, গুপ্ত সম্রাটরাও নিশ্চিতভাবে তার অধিকারী ছিলেন। বিভিন্ন শিলালেখতে প্রসঙ্গক্রমে যেসব উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে তা থেকে বোঝা সম্ভব হয় যে যুদ্ধক্ষেত্রে সম্রাট ছিলেন সর্বাধিনায়ক। এছাড়া, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক কর্মচারীদের তিনি নিযুক্ত করতেন। কিছু মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীর অবস্থান সত্ত্বেও শাসন নীতি পরিচালনায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাঁকেই নিতে হত। সাম্রাজ্যবাদী গুপ্ত শাসকদের ক্ষমতা কেবল যুদ্ধবিগ্রহ ও যুদ্ধে জয়লাভের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ছিল না। তাঁরা অনেকক্ষেত্রেই গরিব ও অনাথ আতুরদের প্রতি দান-ধ্যান করতেন ও সমবেদনা জানাতেন। উল্লেখ্য, সমুদ্রগুপ্তের প্রশস্তি রচয়িতা হরিষেণ তাঁর গুণগানের কথা বলতে গিয়ে এক জায়গায় বলেছেন যে গুপ্ত সম্রাট নিজেকে গরিব, আশ্রয়হীন ও দুর্গত ব্যক্তিদের কাজে উৎসর্গ করতেন। এছাড়া, স্কন্দগুপ্ত সম্পর্কেও প্রায় ঐ ধরনের মন্তব্য প্রকাশ করেছেন তাঁর সুরাষ্ট্রের শাসনকর্তা পর্ণদত্ত ৪৫৬-৫৮ খ্রিস্টাব্দের জুনাগড় শিলালেখতে। তবে মনে রাখা দরকার, এই সমস্ত উঁচুমানের দাবিগুলির সত্যতা সম্পর্কে সংশয় আছে। কেননা, এগুলি সবই গুপ্ত সম্রাটদের প্রশস্তি।
জাতক ও অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত যুগ ও তারও পূর্ববর্তী যুগের ন্যায় গুপ্তযুগে সম্রাটদের পদ ছিল বংশানুক্রমিক। বংশপরম্পরায় সম্রাটরা শাসন করে যেতেন। সম্রাটের পরবর্তী স্তরে বিরাজ করতেন যুবরাজ। অনেক সময় সম্রাটরা তাঁদের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করে যেতেন। বসারে প্রাপ্ত একটি অভিজ্ঞান মুদ্রায় উৎকীর্ণ ‘শ্রীযুবরাজ ভট্টারক বালাধিকরণস্য' শব্দগুলি থেকে অনুমান করা হয় যে যুবরাজ নিয়মিতভাবে তাঁর একটি বিশেষ কার্যালয় তত্ত্বাবধান করতেন।
গুপ্তযুগে কেবল রাজা বা যুবরাজ কর্তৃক সমগ্র শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হত মনে করলে ভুল হবে। বস্তুত, সাম্রাজ্যবাদী গুপ্ত শাসকেরা গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অভ্যস্ত ছিলেন। এ যুগের বিভিন্ন লেখ ও মুদ্রায় উল্লেখিত উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের উল্লেখ থেকে এই আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিচয় মেলে। উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মহাবলাধিকৃত (সেনা বিভাগের প্রধান,
যাঁকে সাতবাহন আমলের মহাসেনাপতির সঙ্গে তুলনীয় বলে মনে করা হয়ে থাকে)। 'মহাবলাধিকৃত'র নিয়ন্ত্রণে ছিল তার অধস্তন কিছু কর্মচারী, যেমন 'মহাশ্বপতি' (অশ্ববিভাগের প্রধান), ‘মহাপিলুপতি' (হস্তি বিভাগের প্রধান), ‘ভট্টাশ্বপতি' (নিয়মিত, অশ্ব বিভাগের প্রধান) এবং 'বলাধিকৃত' (সেনাপতি)। মহাবলাধিকৃত-র প্রায় সমপর্যায়ে ছিল মহাদণ্ডনায়ক, যাঁদের অস্তিত্ব কুষাণ শাসনব্যবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায়। উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে মহাপ্রতিহার (প্রাসাদ রক্ষীর প্রধান)-এর কথাও জানা যায়। তিনি সম্ভবত অন্যান্য প্রতিহার বা দ্বাররক্ষীদের ঊর্ধ্বে বিরাজ করতেন। গুপ্তযুগেই প্রথম ‘সান্ধিবিগ্রহিক' নামে উচ্চপদস্থ কর্মচারীর নাম পাওয়া যায়। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের তারিখবিহীন উদয়গিরি লেখতে উল্লেখিত 'সান্ধিবিগ্রহিক' কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল যুদ্ধ ও শান্তি বিভাগের মন্ত্রী। অর্থাৎ বৈদেশিক দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পদের নাম ছিল সান্ধিবিগ্রহিক। এছাড়া সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তিতেও অন্যান্য উচ্চপদভুক্ত কর্মচারীদের সঙ্গে সান্ধিবিগ্রহিক'-র উল্লেখ আছে।
গুপ্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে অমাত্য বা ঐ জাতীয় কর্মচারীদের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। উল্লেখ্য অর্থশাস্ত্র, জাতক এমনকি প্রাক গুপ্তযুগের লেখমালাতে অমাত্যের উল্লেখ আছে। তবে গুপ্তযুগে 'অমাত্য' এই শব্দটির পরিবর্তে কুমারামাত্যর উল্লেখ লক্ষণীয়। সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তি এবং ভিটা ও বসারে প্রাপ্ত অভিজ্ঞান মুদ্রায় কুমারামাত্য'র উল্লেখ আছে। কুমারামাত্যদের কাজের এক্তিয়ার সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে। কেননা, গুপ্তযুগে বিভিন্ন ধরনের কাজের সঙ্গে কুমারামাত্যদের সংযুক্ত থাকতে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে বিহারের মজঃফরপুর জেলার বসার (প্রাচীন বৈশালী) -এ অভিজ্ঞান মুদ্রাগুলিতে উৎকীর্ণ তিন ধরনের কুমারামাত্যের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এগুলি হল, (১) কুমারামাত্যাধিকরণ, (২) শ্রীযুবরাজ পাদীয় কুমারামাত্যাধিকরণ এবং (৩) শ্রীপরমভট্টারক পাদীয় কুমারামাত্যাধিকরণ। এই তিন ধরনের কুমারামাত্যের মধ্যে শেষোক্ত কুমারামাত্যরা সম্রাটের সচিব হিসাবে যুক্ত থাকতেন। দ্বিতীয় ধরনের কুমারামাত্যরা কুমার অর্থাৎ যুবরাজ হিসাবে কাজ করে তারপর কুমারামাত্য পদে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন এবং প্রথম ধরনের কুমারামাত্যরা সম্ভবত কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত না থেকে জেলার শাসনের সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত থাকতেন।
কুমারামাত্য ছাড়াও আয়ুক্ত (আয়ুক্তক) নামে আর এক ধরনের উচ্চপদস্থ কর্মচারীর অস্তিত্ব গুপ্তযুগে ছিল। প্রসঙ্গত বলা যায় মৌর্য সম্রাট অশোকের লেখমালায় যুত এবং অর্থশাস্ত্রে ও মনুসংহিতায় যুক্ত নামক কর্মচারীদের সঙ্গে গুপ্তযুগের আয়ুক্তদের অভিন্ন বলে মনে করা হয়। সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তিতে 'আয়ুক্ত পুরুষ' নামে কর্মচারী পদের উল্লেখ আছে যিনি সমুদ্রগুপ্ত কর্তৃক বিজিত রাজ্য থেকে আহৃত সম্পদ সংরক্ষণ করতেন। এর থেকে ঐতিহাসিক আর. সি. মজুমদার সিদ্ধান্তে এসেছেন যে খুব সম্ভবত অর্থশাস্ত্র ও মনুসংহিতার যুক্তদের ন্যায় আয়ুক্তরাও রাজস্ব ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এছাড়াও প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা আলোচনা প্রসঙ্গে দেখা যাবে যে কোটিবর্ষ জেলা এবং
পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তির শাসন পরিচালনার সঙ্গেও আয়ুক্তরা যুক্ত ছিলেন। এইভাবে দেখা যাচ্ছে কুমারামাত্য ও আয়ুক্তকরা গুপ্তযুগে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক স্তরের সুপরিচিত প্রশাসনিক পদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এককথায় সাম্রাজ্যবাদী গুপ্ত শাসকদের আমলে কেন্দ্র ও প্রাদেশিক স্তরের শাসনব্যবস্থার মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল কুমারামাত্য ও আয়ুক্তকদের মাধ্যমে।
গুপ্তযুগে সামরিক ও বেসামরিক উভয় ক্ষেত্রেই উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে কোনো স্থায়ী ভেদরেখা ছিল না। একই পদাধিকারী দুই ব্যক্তির সঙ্গে অনেকসময় ক্ষমতার তারতম্য ঘটত। কেননা এমন অনেক উদাহরণ আছে যার থেকে বোঝা সম্ভব হয় যে একই ব্যক্তি একাধিক পদে অধিষ্ঠিত হতে পারত। উদাহরণস্বরূপ সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তিতে উল্লেখিত হরিষেণ (ঐ প্রশস্তির রচয়িতা) একই সঙ্গে সান্ধিবিগ্রহিক, কুমারামাত্য ও মহাদণ্ডনায়ক পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। এছাড়া গুপ্তযুগের শেষ দিকের সম্রাট বৈন্যগুপ্তের একজন সামন্ত শাসক মহারাজ মহাসামন্ত বিজয়সেন একই সঙ্গে মহাপ্রতিহার (প্রধান প্রাসাদ রক্ষী), মহাপিলুপতি (হস্তিবিভাগের প্রধান), পঞ্চাধিকরণো পরিক পাত্যুপরিক (পাঁচটি অফিসের উপরিক বা প্রধান), পুরপালোপরিক (নগর প্রধান) পদ অধিকার করেছিলেন। এছাড়া, একটা পদ থেকে তার তুলনায় উঁচু পদে উন্নীত হবার নজীরও গুপ্তযুগের লেখগুলি থেকে প্রমাণিত হয়। প্রথম কুমারগুপ্তের করমদণ্ড লেখ থেকে বোঝা সম্ভব হয়েছে যে তাঁর আমলে একজন মন্ত্রী ও কুমারামাত্য পরে মহাবলাধিকৃত পদে উন্নীত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, তাঁর পিতা গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলে তিনি মন্ত্রী ও কুমারামাত্য পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়। বিষয়টি হল মহাবলাধিকৃত পদটি ছিল সামরিক বিভাগের প্রধান। কিন্তু মন্ত্রী ও কুমারামাত্য পদটি নিঃসন্দেহে বেসামরিক পদের সূচক। সুতরাং এক্ষেত্রে বেসামরিক পদ থেকে সামরিক পদে স্থানান্তর ও উন্নীত হবার বিষয়টি ইতিহাস-পিপাসু পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গুপ্ত শাসনব্যবস্থায় আমলাতান্ত্রিকতা বিশেষভাবে প্রতীয়মান হয়ে উঠেছিল। বিশেষ
করে উচ্চপদস্থ কর্মচারী পদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে। এই যুগের সাহিত্য ও লেখমালা থেকে বোঝা সম্ভব হয় যে একজন ব্যক্তি উত্তরাধিকারসূত্রে বংশপরম্পরায় তাঁর সংশ্লিষ্ট পদটি অধিকার করেছিলেন। এই যুগের ধর্মশাস্ত্রগুলিতে মন্ত্রীর পুত্রকে মন্ত্রী পদে নিযুক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ঐ পরামর্শ যে কার্যকরী হয়েছিল তা এ-যুগের কয়েকটি লেখমালায় বর্ণিত ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়। সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে জানা যায় যে ঐ প্রশস্তির রচয়িতা মহাদণ্ডনায়ক হরিষেণের পিতা ছিলেন মহাদণ্ডনায়ক ধ্রুবভূতি। হরিষেণ যে ঐ পদটি উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উচ্চপদস্থ কর্মচারী ও মন্ত্রীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে গুপ্ত শাসকেরা উত্তরাধিকারের দাবিকে যে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন তার আরো অনেক প্রমাণ আছে। পূর্বে উল্লেখিত প্রথম কুমারগুপ্তের করমদণ্ড লেখ থেকে বোঝা সম্ভব হয় যে মন্ত্রী শিখর স্বামিনের পুত্র ছিলেন মন্ত্রী পৃথিবীসেন। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে পৃথিবীসেন উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁর মন্ত্রী পদটি লাভ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য
দৃষ্টান্ত হল গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের তারিখবিহীন উদয়গিরি গুহালেখতে বর্ণিত একটি ঘটনা। এই লেখতে যুদ্ধ ও শান্তি বিভাগ অর্থাৎ বৈদেশিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী (সান্ধিবিগ্রহিক) বীরসেন শাব ঘোষণা করেছিলেন যে ঐ পদটি তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলেন। লেখটিতে উদ্ধৃত ‘অন্বয়-প্রাপ্তসচিব্য' শব্দগুলি থেকে তা বোঝা সম্ভব হয়। এছাড়া, পরবর্তীকালের উল্লেখযোগ্য গুপ্ত শাসক বুধগুপ্তের এরান লেখ থেকে বোঝা সম্ভব হয় যে তাঁর সময়ের ঐ অঞ্চলের বিষয়পতি মহারাজ মাতৃবিষ্ণু ঐ পদটি উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলেন। কেননা, ঐ পদভুক্ত তাঁর তিনজন পূর্বসূরির নাম তিনি ঐ শিলালেখতে উল্লেখ করেছেন।
শুধু মন্ত্রী বা উচ্চ কর্মচারীপদ নয়, অনেক সময় গুপ্তদের অধীনস্থ সামন্ত পদও বংশানুক্রমিক হয়ে উঠেছিল। এর অন্যতম উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের ৮২ গুপ্তবর্ষ (৪০২ খ্রিঃ)-এ উৎকীর্ণ উদয়গিরি শিলালেখ। এই লেখতে সনকানিক মহারাজ তাঁর দুই পূর্বসূরি যথা মহারাজ ছগলগ ও তাঁর পুত্র বিষ্ণুদাস এর উল্লেখ করেছেন। সুতরাং সনকানিক মহারাজ উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর পদ লাভ করেছিলেন, এবিষয়ে কোনো সংশয় নেই। এ প্রসঙ্গে এলাহাবাদ প্রশস্তিতে উল্লেখিত সমুদ্রগুপ্তের কাছে বশ্যতা স্বীকারকারী সনকানিক উপজাতির কথা মনে আসে। সনকানিকরা যেহেতু সমুদ্রগুপ্তের বশ্যতা স্বীকার করে করদ রাজ্য হিসাবে তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল এবং ৪০২ খ্রিস্টাব্দের উদয়গিরি লেখতে (সম্ভবত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পশ্চিম ভারত অভিযানের সময়) একজন সনকানিক মহারাজের উল্লেখ গুপ্ত সম্রাটের সঙ্গে পাওয়া যায় সেহেতু মনে করা অযৌক্তিক হবে না যে প্রয়োজনে গুপ্ত সম্রাটকে সামরিক অভিযানে তিনি এবং তাঁর পূর্বসূরিরা সাহায্য করতেন। অধীনস্থ সামন্ত হিসাবে কর ও সামরিক সাহায্য দানের বিনিময়ে সনকানিকরা কিছু প্রশাসনিক অধিকার ভোগ করতেন। এইভাবে উচ্চপদস্থ কর্মচারী, মন্ত্রী এমনকি অধীনস্থ সামস্তপদ উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্তির বিষয়টি থেকে বোঝা অসম্ভব নয় যে গুপ্তযুগে একটা দক্ষ আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছিল।