রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মূলত কবি , কিন্তু মানবজীবনের এমন কোনো দিক নেই , যেখানে রবীন্দ্র - প্রতিভার ছোঁয়া লাগেনি । শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর কিছু নিজস্ব ভাবনা - চিন্তা ছিল । এই উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম এবং বিশ্বভারতী ।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাচিন্তায় প্রকৃতি মানুষ ও শিক্ষার সমন্বয় ঘটেছিল । তিনি শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃতি , মানুষ ও শিক্ষা বিষয়ে হাতেকলমে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন ।
১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর ( ৭ পৌষ , ১৩০৮ ) রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন আশ্রমে প্রতিষ্ঠা করলেন শান্তিনিকেতন ব্রহ্মবিদ্যালয় বা ‘ ব্রহ্মচর্যাশ্রম ' । এটি একটি ব্যতিক্রমী বিদ্যালয় । শান্তিনিকেতন আশ্রম - এর প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হলেন রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ । এর প্রতিষ্ঠাকাল হল ১৮৬৩ সাল । তিনি রায়পুরের ভুবনমোহন সিংহের কাছ থেকে ভুবনডাঙা গ্রামে কুড়ি বিঘা জমি কিনে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন । এর উদ্দেশ্য ছিল নিভৃতে আধ্যাত্মিক সাধনা করা । রবীন্দ্রনাথ নিজে কোনো আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেননি , তিনি মহর্ষি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আশ্রমকেই নিজ কর্মক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করেন । আরও স্পষ্টভাবে বলা যায় যে , মহর্ষির ধর্মসাধনার স্থানকে রবীন্দ্রনাথ জীবনসাধনার ক্ষেত্রে রূপান্তরিত করেন । রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মচর্যাশ্রম ভাবের দিক থেকে আশ্রম , আর রূপের দিক থেকে বিদ্যালয় ।
ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রতিষ্ঠা , ‘ নৈবেদ্য ’ রচনা ও ‘ বঙ্গদর্শন ’ - এর সম্পাদনা সমকালীন । এ সময় তিনি তাঁর রচনাসমূহে প্রাচীন ভারতের যে গৌরবোজ্জ্বল চিত্র এঁকেছেন এবং চতুরাশ্রম সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করেছেন , তারই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর নবপ্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষালয়ে । তাঁর এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল চতুরাশ্রম ও তপোবনের আদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা । এখানে শিক্ষার্থীদের পাদুকা ও ছাতা ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল । তাদের সকাল - সন্ধ্যা চেলি পরে উপাসনায় বসতে হত এবং গায়ত্রী মন্ত্র ধ্যান করতে হত । রান্না ছাড়া অন্যসব কাজই তারা নিজেরা করত । প্রত্যুষে পুষ্করিনীতে শুচিস্নাত হয়ে মুক্ত প্রাঙ্গণে তারা বেদগান করত । সকল ছাত্র ও অধ্যাপক সেখানে সমবেত হতেন । উপাসনা শেষে অধ্যাপকদের পদধূলি গ্রহণের পর শুরু হত পাঠাভ্যাস । পাঠ্যসূচির মধ্যে বাংলা , ইংরেজি , সংস্কৃত , অঙ্ক , ইতিহাস , ভূগোল , বিজ্ঞান — সবই ছিল । আরাম বা সুখভোগ নয় — সরল জীবনযাত্রা , গুরুসেবা , অতিথিসেবা প্রভৃতি পূর্বকালের আশ্রমিক আদর্শে ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়াই ছিল লক্ষ ।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার উদ্দেশ্য হল ‘ মানুষ ' তৈরি করা । তিনি বলছেন , ' মানুষ গড়াই শিক্ষা , মানুষ বলিতে যে যেমন বুঝিয়াছে সে সেই অনুসারেই মানুষের প্রণালী প্রবর্তন করিতে চাহিয়াছে । ' তিনি বারবার ‘ ছেলেদের মন জাগানোর কথা বলতেন । তিনি বলতেন যে , শিক্ষককে লক্ষ রাখতে হবে ছাত্রদের “ মূল্যবান জীবন যেন শুকিয়ে না যায় ” ।
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে শিক্ষা হবে মুক্ত প্রকৃতির কোলে — মুক্ত আকাশের নীচে । চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তিনি একটি ‘ খোপওয়ালা বড়ো বাক্স ' বলে অভিহিত করেছেন । তাঁর মতে , মানুষের দুটি পরিবেশ — এক পরিবেশ সমাজ , অপর পরিবেশ প্রকৃতি । সমাজ থেকে মানুষ পায় তার ভাষা , উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ভাবসম্পদ , ভদ্র রীতিনীতি প্রভৃতি । আর দেহ মনের উন্নতির জন্য মানুষ ঋণী প্রকৃতির কাছে । তিনি বিশ্বাস করতেন যে , তৃণ - গুল্ম - লতা , জলধারা , বায়ুপ্রবাহ , ছায়ালোকের আবর্তন , জ্যোতিষ্কদলের প্রবাহ , পৃথিবীর অনন্ত প্রাণী পর্যায় এবং জগতের সকল অণু - পরমাণু — সব কিছুর সঙ্গেই মানুষের নাড়ীর যোগ । তিনি বিশ্বাস করতেন যে , শান্তিনিকেতনের গাছপালা এবং পাখিরাই ছাত্রদের শিক্ষার ভার নেবে । তাঁর একান্ত ইচ্ছা ছিল যে , প্রভাতের আলো , শ্যামল প্রান্তর এবং গাছপালা যেন শিশুদের অন্তর স্পর্শ করতে পারে ।
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে , শিক্ষালাভের মধ্য দিয়ে আনন্দ লাভ শিক্ষার একটি আবশ্যিক শর্ত । এই উপলব্ধি থেকে তিনি শান্তিনিকেতনে আনন্দ নিকেতন গড়ে তোলার আয়োজন করেছিলেন । সেখানে প্রকৃতির সহজ উদার পরিবেশে শিশুরা মনকে মুক্তি দিতে পেরেছিল । কবি তাদের জন্য গান রচনা করেন , ঋতু বন্দনা শিখিয়ে দেন , বর্ষা , বসন্তে উৎসবের আয়োজন করেন । খেলায় - গানে - অভিনয়ে - উৎসবে আশ্রম জীবন মুখর হয়ে ওঠে । একদা শান্তিনিকেতনের এক শিক্ষক তাঁর কাছে ছাত্রদের দুরন্তপনার অভিযোগ করলে তিনি বলেন— “ দেখুন , আপনার বয়সে তো কখনও তারা গাছে চড়বে না । এখন একটু চড়তে । দিন । গাছ যখন ডালপালা মেলেছে , তখন সে মানুষকে ডাক দিচ্ছে । ওরা ওতে চড়ে থাকলেই বা । ” শিক্ষার সঙ্গে আনন্দকে মিলিয়ে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের শিক্ষানীতির একটা বৈশিষ্ট্য ।
শিক্ষা মানুষকে নিয়ে মানুষকে বাদ দিয়ে শিক্ষা পরিপূর্ণতা পেতে পারে না । তিনি শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করে ছাত্রদের বিশ্বপ্রকৃতির কোলে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন । কালক্রমে তাঁর মনে হল যে , মানুষে মানুষে যে বিরাট ব্যবধান আছে , তাকে অপসারিত করে মানুষকে সর্বমানুষের বিরাট লোকে মুক্তি দিতে হবে । এ জন্যই তিনি “ জ্ঞানের আদিনিকেতনে ”অর্থাৎ হাড়ি - ডোম - কৈবর্ত - বাগদির জীবনে প্রবেশ করার কথা বলছেন , কারণ জীবনে জীবন যোগ করা না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হবে গানের পসরা । এ জন্যই তিনি শান্তিনিকেতন - সন্নিহিত সাঁওতাল গ্রামে নানা উন্নয়নমূলক কাজের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন ।
বিশ্বভারতী ’ প্রতিষ্ঠা ও তার উদ্দেশ্য :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিশ্বভারতী পরিকল্পনা তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন যত্র বিশ্বম ভবত্যেকনীড়ম অর্থাৎ যেখানে বিশ্ব একটি নীড়ে পরিণত হবে । এই আদর্শের ভিত্তিতে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয় । প্রকৃতির সঙ্গে থেকে প্রকৃত শিক্ষালাভে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাসী ছিলেন । এইজন্য তিনি শান্তিনিকেতনের প্রকৃতির মধ্যে তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন । তাঁর উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতির কাছে থেকে আদর্শ প্রাকৃতিক পরিবেশে শিশু ও কিশোরদের বড়ো হতে সাহায্য করা । তাই বিশ্বভারতীতে ছাত্রদের ক্লাস হত আকাশ ও গাছের তলায় । মানুষের সঙ্গে শিক্ষার সমন্বয়ের জন্য পল্লিগ্রামের সঙ্গেও শান্তিনিকেতনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল । শান্তিনিকেতন লাগোয়ো কিছু গ্রামের মানুষের তৈরি প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রির ও সকলের মিলনের ক্ষেত্র হিসেবে পৌষমেলা ’ - র আয়োজন করা হয় । এই মেলায় আশপাশের গ্রামের মানুষেরা তাদের ঘরোয়া সামগ্রী , যেমন— মাটির হাঁড়ি , বেতের তৈরি ধামা , কুলো , লোহার তৈরি কড়াই , হাতা প্রভৃতি বিক্রি করে । তা ছাড়া জমিতে উৎপন্ন ফসলও তারা বিক্রির জন্য নিয়ে আসে । অর্থাৎ বিশ্বভারতীয় শিক্ষা ছিল মানবতাবোধের শিক্ষা , মূল্যবোধের শিক্ষা যে শিক্ষা আজকের সমাজের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
যে শিক্ষা মনুষ্যত্ববোধের জন্ম দেয় , সেই শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা— এটাই হল রবীন্দ্র শিক্ষাদর্শনের মূল কথা । রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ভাবনা শুধু বাংলা বা ভারতে নয় , পৃথিবীর ইতিহাসে এক দিকচিহ্ন হয়ে আছে । তিনি বিশ্বভারতীকে যথার্থই বিশ্বজাতির মহামিলনের ক্ষেত্রে পরিণত করতে পেরেছিলেন ।